ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঈদ উৎসবের একাল সেকাল

রাশেদ রহমান
🕐 ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৮

একটা সময় ছিল যখন ঈদের দিন গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়, শহরের মহল্লায় মহল্লায় আড্ডা বসত। ঈদের ছুটিতে এই আড্ডায় মেতে ওঠা ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, আইপ্যাড।

যোগাযোগের জন্য এখন আর কোথাও সশরীরে উপস্থিত হতে হয় না, আড্ডা চলে ফেসবুকে, ফোনেই। এ কারণে ঈদ আড্ডার চিরপরিচিত দৃশ্যও এখন আর দেখা যায় না।
মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ। বিশ্বের সব দেশে, সব সময়ে মুসলমানদের ঈদ উদযাপনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও দেশ ও জাতি ভেদে এবং সময়ভেদেও ঈদ উদযাপনের রীতিতে ভিন্নতা দেখা যায়। বাংলাদেশেও ঈদ উদযাপনের স্বতন্ত্র কিছু রীতি আছে। তবে সময়ভেদে সেই রীতিতে দিন দিন পরিবর্তন এসেছে। লক্ষ করলে দেখা যায়, আশি ও নব্বই দশকের ঈদের সঙ্গে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের ঈদ উদযাপনে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে ঈদ বিনোদনের বাধ্যতামূলক অনুষঙ্গ ছিল আনন্দমেলা। কেবল লাইনবিহীন সেই যুগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঈদের রাতে প্রচারিত হওয়া সেই আনন্দমেলার জন্য এক বছর অপেক্ষা করে থাকত ছেলে-বুড়ো সবাই। টিভি দেখার ছলে পরিবারের সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। বিটিভির ঈদের নাটকও ছিল ঈদ বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ। আরেকটা যে চল ছিল সেটা হলো, ঈদের আগের দিন পাড়ায় পাড়ায় ক্যাসেট প্লেয়ারে ফুল ভলিউমে গান বাজানো। দেখা যেত রিলিজ হওয়া শিল্পীদের নতুন এলবাম কি না, তারপর সেটা উচ্চৈঃস্বরে বাজানো, তখনকার ঈদ উদযাপনের পরিচিত দৃশ্য।
শহরে বসবাসকারী পরিবারগুলো অবশ্যম্ভাবীভাবে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত যেখানে তাদের পরিজনরা অপেক্ষা করে আছে। শহরের অফিস-আদালতে কাজ করা কর্মব্যস্ত প্রাপ্তবয়স্করা আর স্কুলের পড়ার চাপে নাভিশ্বাস ওঠা শিশুরা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেত। সে সময় প্রতি গ্রামে ঈদের জামাত হতো না, কয়েক গ্রাম মিলে একটি জামাত হতো। কয়েক গ্রামের লোক একত্র হওয়ার সুযোগ পেত ঈদ জামাতকে ঘিরে। এ ছাড়া ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ঈদকার্ড আদান-প্রদানের রীতি ছিল।
সে দিনগুলোতে শহরে ও গ্রামে মানুষ ঈদের দিন প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যেত, খাওয়া-দাওয়া করত। খাবারের আইটেম হিসেবে পরিবারগুলোর আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পদ রান্না করা হতো। পোলাও, রোস্ট, বিরিয়ানি, মুরগি, গরু প্রভৃতি ছিল কমন আইটেম। আর ঈদের দিন সেমাই রান্না বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। তখনো নতুন কাপড়-জুতো কেনার চল ভালোভাবেই ছিল। তবে ফ্যাশন নিয়ে এতটা প্রচারণা হতো না। সাধারণত বাচ্চাদের উৎসাহই বেশি থাকত জামা-জুতো নিয়ে। রেডিমেড পোশাকের চল না থাকায় সবাই দর্জিবাড়ি ছুটত।
তবে আজকাল ঈদ উদযাপনের রীতি-নীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ঈদ উদযাপন ঈদ শপিংকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। রমজান শুরু হতে না হতেই সম্ভ্রান্ত সব বিপণিবিতানে ছেলে, বুড়ো, তরুণ, তরুণী, নারী-পুরুষ সবার আনাগানো শুরু হয়। লাখ টাকা মূল্যের শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবির কেনাকাটা হয়। এখন আর জামা বানানোর জন্য দর্জিবাড়ি ছুটতে হয় না। রং-বেরঙের রেডিমেড পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। এখন ঈদ শুভেচ্ছা জানানো হয় সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে, ফোনকল বা মেসেজের মাধ্যমে। অনেকে সে কষ্টটাও করতে চান না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই শুভেচ্ছা জানানোর কাজটা সেরে ফেলেন।
অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল বহু পরিবারই এখন আর ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যান না। তাদের প্রথম পছন্দ এখন বিদেশের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট। নিজের বাস্তুভিটায় দুটি দিন থাকার বদলে পৃথিবী ঘুরে দেখতেই এখন বেশি আগ্রহ পান তারা। যারা দেশে থাকে তারাও আজকাল আর আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে তেমন বেড়াতে যায় না। ফ্যান্টাসি কিংডম কিংবা চিড়িয়াখানাই তাদের পছন্দের গন্তব্য। ঈদকে কেন্দ্র করে নতুন এলবাম প্রকাশ করবার রেওয়াজ অনেক আগেই উঠে গেছে, মহল্লা সংস্কৃতি উঠে যাওয়ায় ঈদের আগের রাতে হাই ভলিউমে গানও আর শোনা যায় না। এ ছাড়া প্রায় প্রতি গ্রামেই এখন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ জামাতকে ঘিরে বিভিন্ন গ্রামের মানুষের মিলনমেলার ঘটনাও এখন আর সব জায়গায় দেখা যায়। দেশে কেবল লাইন আসার পর মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুম থেকে বিটিভি তার একচ্ছত্র আধিপত্য হারিয়েছে। আনন্দমেলা, ছায়াছন্দ আর বিশেষ নাটকের জন্য অপেক্ষা এখন আর কেউ করে না। দেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলেই এখন মানুষ ঈদ বিনোদন খুঁজে নেয়; অনেকে তো আবার হিন্দি, ইংরেজি চ্যানেলেই বুঁদ হয়ে থাকেন। আলাদাভাবে ঈদের অনুষ্ঠান দেখার বিষয়টি তাদের মধ্যে কাজ করে না। খাদ্য তালিকায় এখনো আগের মতো ঐতিহ্যবাহী পোলাও, কোরমার আর সেমাইয়ের চল রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানান দেশের নানান পদ। কাস্টার্ড, চিলি বিফ, স্টেকের মতো পশ্চিমা খাবারও জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির ঈদের রেসিপিতে। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য এখন আর কেউ মাঠে কিংবা ছাদে ছুটে যায় না। টিভির ব্রেকিং নিউজ কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমেই চাঁদ ওঠার খবর পেতে সবাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
এত পরিবর্তনের পরও ঈদ এখনো বাঙালির জীবনে আসে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও আনন্দের বার্তা নিয়ে। আগের মতো আজকের ঈদও মানুষকে সব হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মিলেমিশে নতুন ত্যাগে শোকে একই দলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যাত্রা শুরু করার উৎসাহ জোগায়।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper