ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পশ্চিম বগুড়া রোড থেকে লাকুটিয়া জমিদারবাড়ি

হাসনাত মোবারক
🕐 ১:৪২ অপরাহ্ণ, জুন ১৭, ২০২০

ধান নদী খালবেষ্টিত জনপদের নাম বরিশাল। এই জনপদকে ব্রাত্যজনের বরিশাল নামে অভিহিত করা হয়। অরুন্ধতী রায় এবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন অরুন্ধতীকে নিয়ে সাহিত্যিক আনিসুল হক বলেছিলেন, সরদার ফজলুল করিমের বাড়ি বরিশালে, অরুন্ধতী রায়ের পিতৃভূমিও। প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশাল ভ্রমণকথায় অনেক অভিজ্ঞতাই তো লেখা যায়। আপাতত দৃশ্যের অন্তরালে কিছু স্মৃতি হয়ে থাকুক। পুরাকীর্তি আর আলোকোজ্জ্বল জলরাশিতে দৃকপাত করে আসি।

২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে রাত ৮টায় সদরঘাটে পৌঁছালাম। ট্রাভেল ট্যুরের রিকুইজিশনে আমিসহ দুজন। হঠাৎ করে সহকর্মী পিন্টু সাহেব উপস্থিত। তার বাড়ি বৃহত্তর বরিশালে। তাকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমরা আনন্দিত। দ্রুত ডাবল কেবিনের চাবিটি নিয়ে নিলাম। এরপর শুরু হলো সেলফি আর ফটোস্যুটের কেরামতি। সাইরেন আর আলোয় মুখরিত বুড়িগঙ্গা। মানুষের কত ব্যস্ততা। কত কত মানুষের মুখ। আলো ও জলের মাঝে মিশে যাচ্ছে। রাতের সুমিষ্ট বাতাসের তালে লঞ্চ চলছে মৃদুমন্দ ছন্দে। দু’পাড়ের গ্রামগুলো দুলছে। আশ্বিনের রাতের আকাশ অলংকৃত করছে সুডৌল চাঁদ। চাঁদের আলো ও জলের যে গভীর সখ্য রয়েছে সেটা এই ভ্রমণে বুঝলাম। 

বরিশাল লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম রাত তিনটায়। এমন সময় ঘাট থেকে না নেমে কেবিনে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা লঞ্চঘাট থেকে কাশিপুরের দিকে রওনা দিলাম। শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের পথ। রেস্ট হাউজে যাওয়ার পথে কুয়াশায় মোড়ানো শরতের সকাল। শুভ্র কাশবন মনটা চনমনে হয়ে উঠল। রেস্ট হাউজে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গন্তব্য রেখায় পা ফেললাম। শহরের মূল কেন্দ্র সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হল। তার অপজিটে সকাল সন্ধ্যা হোটেলে গিয়ে ফিরনি লুচি দিয়ে সকালের ভোজপর্ব সম্পন্ন করলাম।

আহারে বিহারে সকাল সন্ধ্যা হোটেলের সকালের ফিরনি পায়েস গ্রামের বাড়ির গরুর দুধের পায়েসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। পনের দিনের ভ্রমণ বিলাসে ওই ফিরনি পায়েসকে ভুলে যাই কেমনে!

অটোযোগে রওনা দিলাম অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ে। সেখানে কাজ শেষে হাঁটতে ফিরতে চোখে পড়ল পশ্চিম বগুড়া রোড। অন্তরের ভেতরটায় ঘাই মেরে উঠল। হা। সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ। এমন পঙ্ক্তির রচয়িতা কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি এখানেই হবে। খুঁজতে লাগলাম। অনেককেই জিজ্ঞাসা করি। কেউ কেউ পরিচিত জীবনানন্দ দাশ নামের বরিশালের কবি। কিন্তু তার সেই ধানসিঁড়ি বাড়িটির সুলুকসন্ধান দিতে পারে না। রাস্তার মোড়ের মুখে ধানসিঁড়ি লেখা দুটো নেমপ্লেট, পাশেরটায় জীবননান্দ স্মৃতি পাঠাগার। নিশ্চিত হলাম। এখানেই প্রিয় কবির বাড়ি। যিনি লিখেছেন, মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ।

পাশের দোকানির কাছে জিজ্ঞাসা করলাম। ভাই জীবনানন্দ দাশের বাড়ি কোনটি? দোকানি ওই ধানসিঁড়ি লেখা নেমপ্লেট দেখিয়ে বললেন, ওই গলির মধ্যে। দুর্ভাগ্য আমার, গলির ভেতর ঢুকে অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছি। বাট কোন বাড়িটা স্পেসিফিকভাবে বলতে পারেননি কেউ।

কোন আঙিনায় কবি থেকেছেন। ধানসিঁড়ি লেখা নেমপ্লেটকে সামনে রেখে একটা ফটোস্যুট নিলাম। তারপর মোড় ঘুরেই চোখধাঁধানো লাল সুরম্যের অক্সফোর্ড মিশন বা এপিফানি গীর্জায় মন আটকে গেল। পাঁচিল টপকে মন ঢুকে পড়ল মিশনের মধ্যে। কী আছে? বেরসিক গেটম্যান ঢুকতে দিল না ভেতরে। আক্ষেপের বুদবুদ জমা হতে থাকল। কিছু করার নাই।

বরিশাল শহরের এমাথা ওমাথা টানা ছয়দিন চইচই করে ঘুরলাম। কবি হেনরী স্বপনদার সঙ্গে গনগনে মধ্যদুপুরের আড্ডা।

২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে সব ব্যস্ততা চুকিয়ে ইচ্ছাডানায় উড়াল। কোথায় যাওয়া যায়! গুগল মামার সহযোগিতায় পেয়ে গেলাম। লাকুটিয়া জমিদারবাড়ি। বরিশাল শহরের উপকণ্ঠে ৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত অনন্য এই পুরাকীর্তি। বরিশাল সদরের ব্রজমোহন কলেজের পাশে নতুনবাজার থেকে অটোযোগে রওনা দিলাম। বনবীথি তরুলতার ফাঁক গলে ঝরে পড়ছে দুপুরের রোদ। আঁকাবাঁকা সরু খাল নালা। ঘোলা জল গড়ে যাচ্ছে। অপার সৌন্দর্যকে পাশ কাটিয়ে পেয়ে গেলাম লাকুটিয়া বাজার। অর্থাৎ জমিদারবাড়ির মোড়। ১৫ টাকা ভাড়া গুনতে হল। মোড়ের ইটাপাড়া রাস্তা দিয়ে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। এরপর পেয়ে গেলাম জমিদারবাড়ি।

এই চুন সুরকির ভাঁজপত্রে জমানো রয়েছে কত কত মানুষের স্মৃতি। হাস্যধ্বনি। কারুকার্যখচিত বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থা পড়ে আছে। অনুমান করা হয় ১৬০০ কিংবা ১৭০০ সালে জমিদার রাজচন্দ্র রায় বাড়িটি নির্মাণ করেন। জমিদার বংশের গোড়াপত্তন করেন রূপচন্দ্র রায়। এই বংশের শেষ জমিদার ছিলেন দেবেন রায় চৌধুরী। এখানে তাদের পূর্বসূরি কেউ নাই। দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়ির পশ্চিম পাশে রয়েছে সুবিশাল দীঘি। নাম সারসি দীঘি। দীঘির শানবাঁধানো ঘাটে বসলাম। শান্ত জলে উড়াল দিয়ে পড়ছে পাখি। ছোঁ মেরে অদূরের গাছের ডালে বসছে। এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ক্লান্তি দূর হল। ফিরলাম এক বুক প্রশান্তির পরশ নিয়ে।

কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে সড়ক অথবা জলপথে উভয় পন্থায় যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সড়কপথে টেকনিক্যাল-গাবতলী থেকে সব ধরনের বাস ২৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া। জলপথে সদরঘাট থেকে রাত ৮ থেকে ৯টার মধ্যে অনেক লঞ্চ বরিশালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। লঞ্চের ডেকের ভাড়া ১৫০ টাকা, ডাবল কেবিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। আবাসন হিসেবে ভালো মানের হোটেলগুলোর মধ্যে প্যারাডাইস টু ইন্টারন্যাশনাল, গ্র্যান্ড প্লাজা, হক ইন্টারন্যাশনালসহ মাঝারি মানের অনেক হোটেল রয়েছে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper