ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অগ্নি ঝুঁকির রাজধানী

বিবিধ ডেস্ক
🕐 ৩:০৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯

যানজট, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বসবাসের অযোগ্য শহর ঢাকা। তার ওপর অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকা শহরেই দুই হাজার ৮৮টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। বিগত দশ বছরে সারা দেশে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। যাতে এক হাজার ৫৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শর্ট সার্কিট থেকেই ৩৯ শতাংশ আগুন ধরেছে বলে জানা যায় অন্য আরেকটি প্রতিবেদন থেকে। পৃথিবীতে অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকাকে।

বনানী এফআর টাওয়ার
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩৬ দিনের মাথায় বড় ধরনের আগুনে পুড়ে অভিজাত এলাকা বনানীর বহুতল ভবন ফারুক-রূপায়ণ (এফআর) টাওয়ার। চলতি বছরের ২৮ মার্চের ঘটনা। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ, বিমান এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৬ ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। নিহতের মধ্যে কারো মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে। শ্রীলঙ্কার এক নাগরিকসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বাঁচার চেষ্টায় লাফিয়ে পড়ে।

এ ঘটনায় আরও ৭৬ জন আহত হয়েছেন বা ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে ফারুক নামের এক ব্যক্তির জমিতে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়নের নির্মাণ করা ২২ তলা ভবনটি সংক্ষেপে এফআর টাওয়ার নামেই পরিচিত। এক দশক আগেও সেখানে একবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হতাহতের এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। উদ্ধার তৎপরতার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক তদারকি করেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দেখা যায়, ওই ভবনের সপ্তম বা অষ্টমতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর তা উপরের দিকে ছড়াতে থাকে। আতঙ্কে বিভিন্ন ফ্লোরে শুরু হয়ে যায় হুড়োহুড়ি, তাতে বেশ কয়েকজন আহতও হন। ততক্ষণে ভবনের সামনে বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতার ভিড় জমে যায়। টেলিভিশনগুলো ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। দূর থেকেও বনানী এলাকার আকাশে ধোঁয়ার কু-লী উঠতে দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি ছিটিয়ে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার পর উপরের ফ্লোর জ্বলতে দেখা যায়। সেখানে পানি ছিটানোয় আগুন কমে এলে আবার সপ্তম ও অষ্টম তলায় আগুনের শিখা দেখা যায়।

এদিকে উপরের ফ্লোরগুলোর অনেকে বাঁচার আশায় ছাদে উঠে যান। ১২ তলায় কাচ ভেঙে বেশ কয়েকজনকে হাত নেড়ে উদ্ধারকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেখা যায়। বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় বিভিন্ন ফ্লোর থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গুরুতর আহত বা নিহত হন বেশ কয়েকজন। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা আর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা চিৎকার করে নিষেধ করেও তাদের থামাতে পারেননি।

এভাবেই লাফিয়ে পড়ে প্রাণ যায় শ্রীলঙ্কার নাগরিক নিরস ভিগনারাজার, যিনি কার্গো পরিবহন কোম্পানি স্ক্যানওয়েল লজিস্টিকে কাজ করতেন। এফআর টাওয়ারের ১১ তলায় স্ক্যানওয়াল লজিস্টিক লিমিটেডের কার্যালয়। ওই ভবনের একপাশের আহমেদ টাওয়ার এবং অন্যপাশের আওয়াল সেন্টারে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সেখানে থাকা লোকজন বেরিয়ে আসে। ওই দুই ভবনে থাকা দুরন্ত টিভি ও রেডিও টুডের সরাসরি সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অগ্নিকা-ের সূচনার ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরাও অভিযানে যোগ দেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবীরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় নামেন। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের অ্যাম্বুলেন্স আহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। হেলিকপ্টার থেকেও ওই ভবনের ওপর পানি ছিটাতে দেখা যায়। আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম খান জানান, সামরিক বাহিনীর পাঁচ হেলিকপ্টার এ কাজে অংশ নেয়।

বেলা ৩টার দিকে আগুনের তীব্রতা কমে আসার পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা মই লাগিয়ে উপরের ফ্লোরগুলোতে আটকা পড়া মানুষকে নামিয়ে আনতে শুরু করেন। তখনও অষ্টম তলায় দেখা যাচ্ছিল আগুনের শিখা। উদ্ধার কাজে থাকা ফারার সার্ভিস কর্মী সোহেল রানা মারাত্মকভাবে আহত হন। তিনি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মারা যান।

নিমতলী
২০১০ সালের ৩ জুন। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টার দিকে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন ধরে যায়। ওই কারখানাতেই ছিল বিপজ্জনক কেমিক্যাল। ফলে আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুহূর্তে আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। শত শত মানুষের চোখের সামনে বহু মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়।

আগুনে প্রাণ হারান ১২৪ জন মানুষ। আহত হন অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় অসংখ্য বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। আহতরাই হয়তো বলতে পারেন- সেদিন তাদের চোখের সামনে কী বিভীষিকাময় চিত্রই না ফুটে উঠেছিল। আগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার ওই ঘিঞ্জি এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারছিল না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের।

প্লাস্টিক কারখানায় দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন লাফিয়ে বাড়তে থাকে তখন। আহতদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে নিমতলীর আকাশ-বাতাস। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল মৃতদেহ। আহতদের ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। অনেক মরদেহই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নিমতলীর ওই দুর্ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

৫ জুন রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়। সব হারানো তিনজন অসহায় মেয়েকে প্রধানমন্ত্রী নিজের মেয়ের মর্যাদা দিয়ে তাদের গণভবনে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত কাজটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

বসুন্ধরা সিটি
২০০৪ সালের ৬ আগস্ট রাজধানীর পান্থপথে চালু হয় আটতলায় প্রায় পৌনে তিন হাজার দোকান নিয়ে বসুন্ধরা সিটি। মূল ভবনসংলগ্ন একটি ২১তলা ভবন বসুন্ধরা গ্রুপের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বসুন্ধরার ওই ২১তলা কার্যালয় ভবনে আগুন লেগে সাতজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন। এরপর পনের সালের ৩ সেপ্টেম্বর মূল বিপণিবিতান ভবনের অষ্টম তলায় (ফুডকোটে) একটি খাবারের দোকানে আগুন লাগে। তবে এতে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এর মাঝে আরেকবার বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগলেও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাতে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সর্বশেষ ঘটনা ঘটে সোল সালে। তখনো ১১টা বাজেনি। এর মধ্যেই আগুনের খবর। ষষ্ঠতলায় সি ব্লকে বন্ধ কয়েকটি জুতার দোকান থেকে গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বিপণিবিতানটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা জড়ো হয়েছেন, মাঝে মাঝে অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার থেকে রাসায়নিকও ছুড়ে মারছেন। তারা প্রথমে অভয় দিলেও কিছুক্ষণ পরেই ব্যবসায়ীসহ সবাইকে বাইরে যেতে বলে কর্তৃপক্ষ। এরপর সারা দিনই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাটে কয়েক হাজার ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীর। ধোঁয়ায় নাক-মুখ চেপে, বৃষ্টিতে ভিজে তারা তাদের দোকানের অবস্থা জানার চেষ্টা করেছেন। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তাজরীন ফ্যাশন
২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দুঃসহ সেই স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ওই ঘটনায় নিহত-আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের। ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এমন দাবি শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর। তবে, বিজিএমইএ বলছে, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বঞ্চিতদের সহায়তা দিতে তারা প্রস্তুত।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সন্ধ্যার পরপরই জ্বলে ওঠে, আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন গার্মেন্ট। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেন আটতলা ভবনটিতে কর্মরতরা। কিন্তু ভবনের প্রধান ফটক তালাবন্ধ থাকায় সেদিন আগুনে পুড়ে প্রাণ হারান তাজরীনের ১১৩ জন শ্রমিক। আর বাকিরা প্রাণে বেঁচে গেলেও অনেকেই আহত হন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের চোখে এখনও জ্বলজ্বলে সেদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি।

ক্ষতিগ্রস্তরারা তখন গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমে আগুন লাগলে বুঝতে পারিনি আমরা। কাজ বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করি সবাইকে কি হয়েছে। এরপরেই দেখি পুরো ফ্লোর ধোঁয়ায় অন্ধকার। অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি। লাশের চিহ্নও পায়নি। টাকা পয়সাও পায়নি। সেদিনের অগ্নিকাণ্ডে বেশি মাত্রায় পুড়ে যাওয়ায় আজও লাশ শনাক্ত করা যায়নি ৫৩ জনের। যাদের ঠাঁই হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে।

ডিএনসিসি মার্কেট
২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি ভোরবেলা গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মার্কেটটির বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর অস্থায়ীভাবে দোকান তৈরি করে মার্কেটটি চালু করা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ ভোরে আবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভোর ৫টা ৪৮ মিনিটে মার্কেটের কাঁচাবাজারের পূর্ব পাশে আগুন লাগে। এ সময় আগুন ছড়িয়ে পড়ে মার্কের অন্যান্য দোকানে।

প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফায়ার সার্ভিসের দল ঝাপিয়ে পড়ে আগুন নিভাতে। একে একে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট আপ্রাণ চেষ্টা করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে স্বক্ষম হয়। এ সময় পুড়ে গেছে অনেক মানুষের স্বপ্ন।

চকবাজারের চুড়িহাট্টা
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। জানা যায়, সেখানে কেমিক্যালের গোডাউন থাকায় আগুন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জন নিহত হন। এছাড়া অগ্নিদগ্ধ ও আহত অন্তত ৬০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।

মর্মান্তিক এ মৃত্যু মিছিলের বীভৎসতা চোখে দেখার মতো ছিল না। কোনো ব্যাগের লাশের নিচের অংশ আছে, আবার উপরের অংশ নেই। হাত আছে, পা নেই। হতাহত হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড় দেখা যায় হাসপাতালে। প্রিয়জনের খোঁজে ছোটেছেন জরুরি বিভাগ থেকে মর্গে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পড়ে থাকা লাশের সারি থেকে প্রিয়জনকে অনেকে চিনতেও পারেন না। মোবাইল ফোনে ছবি দেখিয়ে খুঁজেন স্বজনদের। কেউ প্রিয় সন্তান, কেউবা বাবা এবং অনেকে ভাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। স্বজনদের কান্নায় হাসপাতাল ও চকবাজারের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তাদের সান্তনা দিতে গিয়েও অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। দুর্ঘটনা কবলিত ভবনের দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যাল কারখানা থাকায় আগুন দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টায় চকবাজার এলাকা রূপ নেয় ‘মৃত্যুপুরীতে’।

ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটের ২শ’ কর্মীর প্রায় ৫ ঘণ্টার প্রাণপণ চেষ্টায় রাত সোয়া ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে অংশ নেয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীও। চকবাজার এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয় ফায়ার সার্ভিস।

আগুনের ভয়াবহতা যাতে আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সেইসব ভবনও পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেন এলাকার সাধারণ মানুষও। খুবই ঘনবসতি এবং রাস্তা সরু হওয়ায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। আগুনের সূত্রপাতের ১৫ ঘণ্টা পর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

মর্মান্তিক এ ঘটনায় গভীর শোক জানান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। নিহত ও আহতদের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন সরকার। পুরো ঘটনা প্রথম থেকেই সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঘটনার পরপরই সেখানে ছুটে যান ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের মেয়র সাইদ খোকন। বৃহস্পতিবার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। আগুনের ভয়াবহতার খবর পেয়ে ভোর থেকে হাজার হাজার উৎসুক জনতা চকবাজারের ঘটনাস্থলে আসেন। জনতার ভিড়ে উদ্ধারকাজ চালাতে বেশ বেগ পেতে হয় উদ্ধারকর্মীদের।

সরেজমিন দেখা গেছে, চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের সামনেই পাঁচটি সড়কের সংযোগস্থল। পূর্ব দিক থেকে প্রধান সড়কটি এসে মসজিদের সামনে আরও চারটি সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ পাঁচটি সড়ক এতটাই সরু যে, এর প্রশস্থতা ১৪ থেকে ১৬ ফুটের বেশি নয়। দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলাচল করতে গেলেও যেন লেগে যাবে একটা আরেকটার সঙ্গে। এমন পাঁচটি সড়কের সংযোগস্থলে মূলত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

কড়াইল বস্তি
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ দিবাগত রাত ২টা ৫০ মিনিটে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরআগে ২০১৬ সালের ০৫ অক্টোবর হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে বউবাজার বস্তিতে আগুনে পুড়ে যায় ৫০টি ঘর।
এছাড়া ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর একই বস্তিতে লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১১ জন। একই বছর ১২ মার্চ রাজধানীর পল্লবীর ইলিয়াস আলী মোল্লা বস্তিতে আগুন লাগে। অগ্নিকা-ে বস্তির প্রায় ৫ হাজার ঘরের সব পুড়ে যায়।
এছাড়া মাঝে মাঝেই বস্তিগুলোতে অগ্নিকা- ঘটতে থাকে।

চলন্তিকা বস্তি
রাজধানীর মিরপুরে বস্তিতে অগ্নিকা-ে পঞ্চাশ হাজারের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। তাদের তথ্য অনুযায়ী ঘর পুড়েছে ১৫ হাজারের মতো। ঢাকার মিরপুর ৭ নম্বরের এই বস্তিটি চলন্তিকা বস্তি বলে পরিচিত।

আগুন লাগার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। এ সময় বস্তি সংলগ্ন একটি ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ২০ টি ইউনিটের ১১৫ জন কর্মী কাজ করেন। স্থানীয়রা ধারণা করছেন বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।

বস্তিবাসীদের অনেককেই আগুনের ভয়াবহতা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। তারা জানান, আগুনে তাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই বস্তিতে প্রায় ২০ হাজার পরিবারের ১ লাখ মানুষের বসবাস যাদের সবাই নিম্নআয়ের মানুষ। ৩০ মিনিটের মধ্যেই তাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। জানা যায়, বস্তির অধিকাংশ ঘর কাঠ ও বাঁশের তৈরি। এসব ঘরের ছাদ পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বস্তি সংলগ্ন একটি ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper