এরশাদ পরিক্রমা
বিবিধ ডেস্ক
🕐 ১:৫৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০১৯
একাধারে নিন্দিত, একাধারে নন্দিত। একদিকে স্বৈরাচার, অন্যদিকে ‘হামাক ছাওয়াল’। ৮৯ বছরের দীর্ঘ জীবন নানা চড়াই-উতরাইয়ে ঘটনাবহুল। বিতর্কও পিছু ছাড়েনি কখনোই। বাংলাদেশের রাজনীতির আনপ্রেডিক্টেবল বলে পরিচিত এরশাদের দাফন নিয়েও চলে নানা নাটকীয়তা। খোলা কাগজের এবারের বিবিধ এইচ এম এরশাদকে নিয়ে।
কোচবিহারে জন্ম
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। বাবা মকবুল হোসেন, মা মজিরা খাতুন। মকবুল হোসেন ছিলেন দিনহাটা আদালতের আইনজীবী। মা গৃহবধূ, কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে ক্রয়সূত্রে এরশাদের পরিবারের ঠিকানা হয় রংপুর মহানগরীর নিউ সেনপাড়ায় বর্তমান (স্কাইভিউ) বাড়িতে। মকবুল হোসেন বাংলাদেশে এসেও আইন ব্যবসা শুরু করেন রংপুরের আদালতে। চার ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে এরশাদ মেজো। সবার বড় বোনের নাম ছিল পেয়ারী আর ছোটবেলায় এরশাদের ডাকনাম ছিল ‘পেয়ারা’।
পড়াশোনা
ভারতের কোচবিহারেই পড়াশোনা শুরু। দিনহাটা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) শেষ করেন তিনি। বাংলাদেশের রংপুরে এসে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। সেখানে পড়ার সময় মনোযোগ দেন লেখালেখির দিকে। ছিলেন কলেজ ছাত্রসংসদরে সাহিত্য সম্পাদক। সেখান থেকেই তার কাব্যপ্রীতি শুরু। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। বাবার মতো আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা ছিল এরশাদেরও। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে পড়ার পাশাপাশি ভর্তি হন ল কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া দলের তিনি ছিলেন কৃতী খেলোয়াড়। এছাড়া ১৯৫৩ থেকে ৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা অঞ্চলের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন।
সেনাবাহিনীতে যোগদান
১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৬০-৬২ সালে চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন। ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ। এসময় তার ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। কর্নেল শাফায়াত জামিল ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইয়ে লিখেছেন, অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন এবং যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে যান। এ কারণে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেন, সে অনুযায়ী তার চাকরিচ্যুত হওয়ার কথা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, নীতিমালা অনুযায়ী তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। জনা পঞ্চাশেক অফিসারকে এ জন্য চাকরি হারাতে হয়। কিন্তু একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরও এরশাদ চাকরিচ্যুত তো হনইনি বরং প্রমোশনসহ এজি (অ্যাডজুজেন্ট জেনারেল) পদে অধিষ্ঠিত হন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন, আমার ধারণা, এরশাদ ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর আশীর্বাদপুষ্টদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।
সেনাপ্রধান
১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নিয়োগ করা হয়। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর কর্নেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একই বছর তিনি ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
অবৈধ ক্ষমতা দখল
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত ও পরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তার সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত করে জাতীয় সংসদ বাতিল করেন। নিজেকে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন, যে সাংবিধানিক পদটি একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানেরই প্রাপ্য ছিল। তিনি ঘোষণা করেন, ভবিষ্যতে সামরিক আইনের অধীনে জারিকৃত বিধিবিধান ও আদেশই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সকল আইন অকার্যকর হবে। এভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ১৯৮৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
জাতীয় পার্টি গঠন
এরশাদের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালের ১৩ জুন জাতীয় ফ্রন্ট নামে একটি নতুন মোর্চা গঠিত হয়। এ ফ্রন্টে বিএনপি থেকে শাহ আজিজ গ্রুপ, জনদল ও মুসলিম লীগের একাংশ, গণতান্ত্রিক পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি এবং নির্দলীয়ভাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যোগ দেন। ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটিতে সদস্য ছিলেন ১৩ জন। ১৯৮৫ সালের ১ অক্টোবর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সীমিত আকারে তুলে নেওয়ার পর মাত্র ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাতীয় ফ্রন্টের বিলুপ্তি ঘটানো হয়। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৮৬’র নির্বাচন
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্যে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরশাদ তার জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদকালের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এর আগে কারচুপির মধ্যে অনুষ্ঠিত মে-১৯৮৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচন বর্জন করে। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আহ্বান করেন। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাস করে সেদিন জাতীয় সংসদ সংবিধান পুনর্বহাল করে। এর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখলসহ সামরিক আইন ও বিধিবিধান দ্বারা সম্পাদিত সকল কাজ ও পদক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হয়।
গণঅভ্যুত্থানে পতন
৮৬’র নির্বাচনের পর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। বিরোধীদলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন। প্রধান বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনও বর্জন করে। এরশাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধীদলগুলোর অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে। বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলন আরও বেগবান হয়। একপর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তিন জোটের আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।
৯০ পরবর্তী রাজনীতি
১৯৯১ সালে কারাবন্দি হন এরশাদ। ওই বছরই সংসদ নির্বাচনে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে এবং কোনো কোনোটিতে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। তবে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তার আসন বাতিল হয়ে যায়।
নির্বাচন-২০০৮
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংসদে ২৭টি আসন এবং মোট ভোটের ৭% লাভ করে।
নির্বাচন-২০১৮
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এরশাদের নেতৃত্বে ২২টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। ৮৯ বছর বয়সে জেনারেল এরশাদ এই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন। অব্যবহিত পরে তার অনুপস্থিতিতে ছোট ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন, আর রওশনকে দেন সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ ঘোষণা করেন, তার দল মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাবে। সেবার দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়ে পরে আবার নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন এরশাদ কিন্তু সেটি আর কার্যকর হয়নি। কারণ ওই ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছিল। নির্বাচনের পরেও এক সপ্তাহ তিনি সেখানেই ছিলেন এবং নির্বাচনে তার দল থেকে ৩৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। ওই সংসদে রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ।
শেষ কয়টা দিন
শেষ মাসখানেক ছিলেন বিছানাতেই। উঠে বসলেও হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেননি। অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে গত ২৭ জুন সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে শেষবারের মতো তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা ছিল। ফুসফুস সংক্রমিত ছিল ও ভুগছিলেন কিডনির জটিলতায়। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল সপ্তাখানেকেরও বেশি।
মৃত্যু
‘প্রতিদিন ডাকলে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করেন কিন্তু আজ তা করেননি’ মৃত্যুর আগের দিন ভাই জিএম কাদের বলছিলেন। সেই চোখ মেলা হয়নি। ১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় এরশাদের মৃত্যুর ঘোষণা দেন হাসপাতালের ডাক্তাররা।
দাফন
রাজধানীর বনানীতে দাফন করা কথা থাকলেও রংপুরবাসীর দাবিকে পূরণ করে সেখানেই তাকে দাফন করা হলো তাকে। সম্পর্ক বিচ্ছেদ হওয়া সাবেক স্ত্রী বিদিশাও এরশাদকে রংপুরে দাফন করার দাবি জানিয়েছিলেন।
দুই দিনে চতুর্থ এবং শেষ জানাজা শেষে জীবিত অবস্থায় এরশাদের দাবি অনুযায়ী রংপুর শহরের বাড়ি পল্লী নিবাসেই দাফন করা হয়েছে তাকে। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ৪৪ মিনিটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লাখো ভক্তের ভালোবাসা দিয়ে দাফন সম্পন্ন হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের।