কমেছে উৎপাদন, চাহিদা থাকায় মুনাফার আশা ফুলচাষিদের
যশোর প্রতিনিধি
🕐 ১২:১২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০
পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠেছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ‘গদখালী’ গ্রাম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে দেশের ফুলের রাজধানীখ্যাত গ্রামটি। এ গ্রামের রাস্তার দু’পাশ দিয়ে যতোদূর চোখ যায় শুধু রং-বেরংয়ের ফুলের সমাহার। ফুলচাষে কৃষক লাভবান হওয়ায় মূলত পাল্টে গেছে গ্রামের দৃশ্যপট।
তবে কয়েক মাস আগে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলকে কেন্দ্র করে ঝড়ো হাওয়ায় ক্ষতি না কাটতেই সম্প্রতি গোলাপের ‘কুঁড়ি পচা’ ভাইরাসে ফুলের উৎপাদন কম হয়েছে। আর এতে উৎসব ঘিরে চাহিদা বেশি থাকায় আশানুরূপ দামে ফুল বিক্রি করে লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করছেন ফুলচাষিরা।
স্থানীয়রা জানান, গদখালীসহ আশপাশের এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকাসহ সব জাতের ও রংয়ের ফুলের চাষ হয়েছে। আসন্ন উৎসবগুলো কেন্দ্র করে চাহিদা অনুযায়ী ফুলের যোগান দিতে পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষিরা। মূলত এ মৌসুমকেই টার্গেট করে ফুলচাষ করেন চাষিরা।
গদখালী-পানিসারার ফুলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ফুলের বাজার ধরতে বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন চাষিরা। গোলাপের ‘কুঁড়ি’ দেরিতে আসায় লাগানো হয়েছে বিশেষ ‘ক্যাপ’। এছাড়াও ফুল বাগানের পরিচর্যা, সেচ কাজ, সার প্রয়োগসহ ফুলের সৌন্দর্যবর্ধনে বিভিন্ন রকম পরিচর্যায় ব্যস্ত এ অঞ্চলের চাষিরা।
ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী এলাকার ফুলচাষি সাজেদা বেগম বলেন, চলতি মৌসুমে তিনি এক বিঘা জমিতে গাঁদা, এক বিঘা জমিতে জারবেরা ও ত্রিশ শতাংশ জমিতে গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করেছেন। আসন্ন বিভিন্ন দিবসে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকার ফুল বিক্রি করার আশা করছেন তিনি।
ফুলচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুল একটি লাভজনক চাষ। সারাদেশের মধ্যে যশোর জেলার ফুলের গুণগতমান ভালো থাকায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে বাজারে ভালোমানের গোলাপ প্রতি পিস ১৭-১৮ টাকা, প্রতিপিস গ্লাডিওলাস (রং ভেদে) ৬ থেকে ১২ টাকা, জারবেরা প্রতিপিস ৬ থেকে ১২ টাকা, রজনীগন্ধার প্রতি স্টিক ৪ টাকা এবং প্রতি হাজার গাঁদা ফুল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, বাংলাদেশে ফুলের চাহিদা অনুযায়ী কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ফুল যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। আসছে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবসে এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছেন।
গদখালী বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিপ্রতিবছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসসহ ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি বিশেষ দিনকে টার্গেট করে ফুলের বাজার ধরতে এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকেই চাষিরা ফুল কেটে বাজারে বিক্রি করছেন।
ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, চলতি মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই সম্প্রতি গোলাপ ফুলের ‘কুঁড়ি পচা’ ভাইরাস আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে চাষিদের। এছাড়াও সম্প্রতি কয়েক বছর বিদেশ থেকে প্লাস্টিকের ফুল আমদানির কারণেও ক্ষতি হচ্ছে ফুল চাষিদের।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলার আট উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। তার মধ্যে শুধুমাত্রই ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কৃষক ৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করছেন। সারা বছর ফুল উৎপাদন করলেও বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারি এই তিন দিবসকে ঘিরেই মূল লক্ষ্য থাকে ফুলচাষিদের। আর এ তিনটি দিবসে ফুল বিক্রি করেই মূলত সারা বছরের লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলান এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা।
স্থানীয় কৃষকদের একমাত্র পেশা ফুলচাষ
১৯৯৫ সালের আগে এ অঞ্চলের যে কৃষকরা ধান কিংবা সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেছে, এখন তারা পুরোপুরিই ফুলচাষের ওপর নির্ভরশীল। অন্য ফসলের তুলনায় ফুলচাষ লাভজনক হওয়ায় গদখালীসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে অন্য কোনো ফসল চাষ হচ্ছে না।
ফুলের হাট গদখালী
স্থানীয় চাষিদের উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী নামক স্থানে গড়ে উঠেছে বিশাল একটি ফুলের হাট। প্রতিদিন সকালে সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হাটে ফুলের বেচাকেনা জমে ওঠে, সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে ফুল বেচাকেনা। দেশের একমাত্র পাইকারি ফুলের এ হাটে সারাদেশের ব্যবসায়ীরা ফুল কিনতে আসেন।
ফুলচাষ করে সাবলম্বী কৃষক
১৯৮৩ সালের দিকে স্থানীয় হাতেগোনা কয়েকজন কৃষক ফুলচাষ শুরু করলে তাদের সাফল্য দেখে অনেকেই ফুলচাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। একপর্যায়ে ১৯৯৫ সাল থেকে অধিকাংশ কৃষক ফুলচাষ শুরু করেন। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কৃষক আয়ের উৎস হিসেবে ফুলচাষকে বেছে নিয়েছেন।