নানা দুর্ভোগে বন্যার্তরা
খোলা কাগজ ডেস্ক
🕐 ১০:১০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২২, ২০১৯
বন্যা কবলিত এলাকায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। পানিতে তলিয়ে ও রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি, দুএক জায়গায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতি থাকলেও নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। সারা দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে-
সিরাজগঞ্জ : কেমন কাটছে কাটছে বন্যা কবলিত মানুষদের রাত। গত রোববার রাত সাড়ে ১২টা। সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী ১ নং হইতে ৬ নং ব্লকের ওয়াপদা বাঁধ। সারি সারি হয়ে শুয়ে আছে বন্যা কবলিত মানুষেরা। ক্যামেরা বা মোবাইলে আলো জালাতেই দেখা যায় খোলা আকাশের নীচে ও নৌকার মধ্যে কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে আছে নারী-পুরুষ ও শিশুরা। আর তাদের রাতের সঙ্গী হয়ে এক সাথেই শুয়ে রয়েছে গরু-ছাগল ও রাস্তার কুকুর।
বন্যা কবলিতরা বলছেন, বন্যায় বসতভিটা তলিয়ে গেছে। কোথাও থাকার জায়গা নেই। নেই কাজকর্ম। দুটো টিন ও পলিথিন কেনারও সামর্থ্য নেই। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তার উপর খোলা আকাশের নীচেই রাত কাটাতে হচ্ছে। শুধু তাই নয় চোরের ভয়ে কেউ কেউ রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছে গরু ছাগল হাঁস মুরগী।
সদরপুর : ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার পদ্মা-আড়িয়াল খাঁর চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়নের ১৫টি প্রাথমিক, ১টি হাই স্কুল ও ১টি আলিয়া মাদ্রাসা বন্যা প্লাবিত হওয়ায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ সকল বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত প্রায় তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রীর পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
সদরপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল মালেক জানান,উপজেলার নারিকেল বাড়ীয়া ও চরনাসিরপুর ইউনিয়নের ১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যা কবলিত হওয়ায় ও চরমানাইড় ইউনিয়নের নাদিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী ভাঙ্গনের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। চরনাসিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় বন্যাকবলিত হওয়ায় ও চরবন্দরখোলা সিনিয়র মাদ্র্রাসাটি নদী ভাঙ্গনের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) : ত্রাণের অভাবে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা জুড়ে বন্যার্তরা দুর্ভোগে রয়েছে। উপজেলার ৭ ইউনিয়নের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ বন্যা কবলিত।
দুর্গত মানুষের চাহিদার বিপরীতে সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় অসহায়দের মাঝে বাড়ছে হতাশা। চৌহালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মজনু মিয়া জানান, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বানভাসী মানুষের জন্য ৬৩.৩০ টন চাল ও ৪শ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ পেয়েছি। এর মধ্যে ৪০টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। ৪০টি মেডিকেল টিমও কাজ করছে। ৪৬টি আশ্রয়ন কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তবে বানভাসী মানুষের তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় আমরা বিতরণে সমস্যা হচ্ছে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনও বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে।
বন্যা দুর্গত এলাকায় পানিবন্দী পরিবারগুলোর মধ্যে বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন এবং জ্বালানি সংকট বিরাজ করছে। এদিকে পানিবন্দী মানুষদের বন্যার পানিতে দেখা দিয়েছে, নানাবিধ রোগ জীবানুর ভাইরাস। অনেকে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানাবিধ রোগে। ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া পরিবারগুলো নৌ-ডাকাতির শঙ্কায় রয়েছে। অনেক চরবাসী রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
গাইবান্ধা কৃষি বিভাগ জানায়, বন্যায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১২ হাজার ৮০৩ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত রয়েছে। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে আউশ, আমন বীজতলা, রোপিত আমন, পাট ও শাকসবজি।
জেলা প্রশাসন অফিস জানিয়েছে, গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা এবং ৪৯টি ইউনিয়নের ৩৯০টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৭ জন। ৪৪ হাজার ৭৯২টি বসতবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭৪ হাজার ১৬৯ জন অসহায় মানুষ আশ্রয় নিয়ে আছে। এ পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ১৫০ মে. টন চাল, ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৬ হাজার কার্টুন শুকনো খাবার, ঢেউটিন ৫০০ বান, তাঁবু ৫০০টি ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্ধ পাওয়া গেছে। এছাড়া বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি নির্মাণে সহায়তা দেয়া হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদেরও প্রয়োজনীয় সহায়তা দান অব্যাহত থাকবে বলে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গতকাল সোমবার বিকেল টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৫৭ সে.মি., ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ২৭ সে.মি. উপর দিয়ে এবং করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার ৯ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
জামালপুর : ‘মানবতা ও আদর্শ সমাজ গঠনে আমারা’ এর উদ্যোগে গতকাল দুপুরে জাামালপুরের মেলান্দহ এবং ইসলামপুরে দুই হাজার বন্যার্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আব্দুস সালাম বুলেট। সংগঠনটির ৪০ জন নেতৃবৃন্দ দুপুরে মেলান্দহের নাংলা থেকে নৌকা যোগে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বন্যার্তদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তারা প্রথমেই মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের শিরিঘাট, বানিয়াবাড়ী ও মাহমুদপুর গ্রামের ৬শ পরিবারের হাতে চিড়া গুড় রুটি, মোমবাতি, মেছ ও স্যালাইনসহ শুকনো খাদ্য সামগ্রীর পেকেট তুলে দেন। পরে তারা ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের রামভদ্রা, করিরতাইর, উলিয়া এবং চিনাডুলি ইউনিয়নের দক্ষিণ চিনাডুলি, দেওয়ানপাড়া ও গিলাবাড়ী এলাকার বন্যার্তদের মাঝে আরো ১৪শ পেকেট ত্রাণ বিতরন করেন।
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসি মানুষদের। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলের ঘর-বাড়ি এখনও বন্যার পানিতে তুলিয়ে অছে। বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বরসহ নানা পানি বাহিত রোগ। দুর্গম চরাঞ্চলগুলোতে এ পরিস্থিতি আরো করুন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ৮৫টি মেডিকেল টিম বন্যা কবলিত এলাকাগুলোকে কাজ করার কথা বললেও দুর্গম এলাকার অনেক চরেই গত ১০/১২ দিনেও তাদের দেখা মেলেনি বলে বানভাসীরা অভিযোগ করেছেন।
এ অবস্থায় ঘর-বাড়ি থেকে পানি নেমে না যাওয়ায় চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার পরিবার ১০ থেকে ১২ দিন ধরে নৌকায় বসবাস করছে। ঘরে ফিরতে পারছেন না উঁচু এলাকায় আশ্রয় নেয়া বানভাসী মানুষজনও। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার মোগলবাসা ইউনিয়নের নামাচরের কাশেমের স্ত্রী সাহিদা বেগম জানান, আমার ৪ বছরের মেয়ে মনোয়ারার দুদিন থেকে ডায়রিয়া। পাশের বাড়ির একজনের নিকট থেকে ৪টি স্যালাইন নিয়ে এসে খাইয়েছি। এখনও ভালো হয়নি।
উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চেরাগীর আলগা চরের মানিক মিয়া জানান, আমার সাড়ে ৩ বছরের বাচ্চার দুই দিন থেকে ডায়রিয়া। সেখানে কোন মেডিকেল টিম নাই। ঔষুধও পাওয়ার উপায় নাই। দুইদিন থেকে কাচাকলা সিদ্ধ করে খাওয়াচ্ছি। বানভাসীরা জানান, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এবং হাতে কাজ না থাকায় চরম খাদ্য সংকটে পড়েছেন বন্যা কবলিত দিনমজুর শ্রেনীর মানুষজন।
অন্যদিকে চিলমারী উপজেলার কাচকোল-বেপারীর হাট বাঁধের মাঝিপাড়া এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়ে পড়া চিলমারী উপজেলা শহরের রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা এখনও তলিয়ে আছে। চিলমারী উপজেলার সাংবাদিক গোলাম মাহাবুব রহমান জানান, নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও বাঁধ ভেঙ্গে ঢুকে পড়া পানি কমছে না। এখনও চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিষদ, থানাসহ রাস্তা-ঘাটে এখনও হাটু পানি রয়েছে।
সরকারী-বেসরকারী ভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও তা জেলার ৯ উপজেলায় ৮ লক্ষাধিক বানভাসী মানুষের জন্য অপ্রতুল। জেলা প্রশাসন থেকে এ পর্যন্ত ৮শ মেট্রিক টন চাল, ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোগেও স্বপ্ল পরিসরে শুরু হয়েছে ত্রাণ তৎপরতা।
মানিকগঞ্জ : সম্প্রতি যমুনা নদীর ভাঙনের ফলে প্রায় ২ হাজার শত ৩২ টি বসত বাড়ি, স্কুল, কয়েক শত বিঘা আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠায় বন্ধ রয়েছে।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা দেখা গেছে, যমুনা নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক পরিবার বাচামারা উচ্চ বিদ্যালয়, বাচামারা বিবিসি কলেজ, আমেনা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ে, বাচামারা পাকা সড়কে ঘর-দরজা, ধান-চাল, জিনিসপত্র ও ঈদকে সামনে রেখে কোরবানীর কয়েক শত গরু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। চরকাটারী, বাচামারা, জিয়নপুর, বাঘুটিয়া এই তিনটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের কিছু কিছু বাড়ি-ঘরে হাঁটু পানিতে ডুবে আছে।
দুপুর ১২ টার দিকে কথা হয় যমুনার পাড় ঘেষে চরকাটারী গ্রামের আমোদ আলী স্ত্রী জাহানারা বেগম এর সাথে তার বাড়ির উঠানে ও ঘরে বন্যার পানি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবরিনা শারমিন বলেন, সরকারিভাবে কয়েক দফায় সাড়ে ৬২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। উপজেলা পরিষদের তহবিল থেকে নগদ ৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে।
নাগরপুর (টাঙ্গাইল): টাঙ্গাইলের নাগরপুরে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সোমবার দিনভর উপজেলার দপ্তিয়র, সহবতপুর, ভারড়া ও ধুবড়িয়া ইউনিয়নের বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরন করা হয়। দূর্গত এলাকার প্রতিটি পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল, শুকনো খাবার, খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধ করন ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফয়েজুল ইসলাম সুষম বন্টনের মাধ্যমে এ চার ইউপি’র ত্রাণ বিতরণ করেন।