ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শুরু একার শেষ সবার

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০১৮

লড়াইটা একাই শুরু করেছিলেন আখতার হোসেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে এবং হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গের বেদনার প্রতিনিধি হয়ে একাই বসেছিলেন অনশনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদ এবং পুনঃপরীক্ষার দাবি তুলেছিলেন তিনি। তার একার লড়াই দ্রুতই পরিণত হলো সবার লড়াইয়ে। এবং পুনঃপরীক্ষার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষার নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গতকাল মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। তিনি জানান, ভর্তি পরীক্ষায় যে ১৮ হাজার ৪৬৪ জন শিক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল কেবল তাদের নিয়েই নতুন করে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার দিনক্ষণ জানিয়ে দেওয়া হবে পরে।
গত ১২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি তারা করলেও পরীক্ষা বাতিল এবং পুনঃপরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ইতিবাচক মনোভঙ্গী দেখাচ্ছিল না। উপরন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে গত ১৬ অক্টোবর ‘ঘ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে ২৬ শতাংশেরও বেশি পাসের হার দেখা যায়। যেটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদার জন্য হানিকর বলেই মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আখতার হোসেন। এ শিক্ষার্থী ২০১৫-২০১৬ সেশনে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৪তম স্থান অধিকার করেছিলেন।
প্রশ্নফাঁসের কারণে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন না-এমন তো হতে পারে না। তাই ফল প্রকাশের দিনই ক্যাম্পাসের রাজু ভাস্কর্য চত্বরে প্ল্যাকার্ড সাজিয়ে, হাতে বই নিয়ে আমরণ অনশনে বসে পড়েন আখতার। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে তার খবর ও ছবি। তার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্যাম্পাসে। পরীক্ষা বাতিল ও পুনঃপরীক্ষার দাবিতে ১৭ অক্টোবর ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তারা পরীক্ষার পরদিন ১৩ অক্টোবরও বিক্ষোভ করেছিল। কিন্তু সে বিক্ষোভে কর্ণপাত করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যখন আখতার হোসেন আমরণ অনশনে বসলেন আর তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ শুরু করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন তখন টনক নড়লো কর্তৃপক্ষের। আখতার হোসেন অনশন শুরু করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী উন্ন্যাসিক ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘সবার ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কোনো কিছু সঠিক মনে না হলে প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। এটি নিয়ে আমাদের কোনো ধরনের আপত্তি নেই। তবে তার কোনো বক্তব্য থাকলে আমাদের লিখিত দিতে পারে।’
অনশনের দ্বিতীয় দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আখতার হোসেন। তখনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ তাকে দেখতে পর্যন্ত আসেননি। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। অবশেষে তৃতীয় দিন (১৮ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী অনশনরত আখতারকে দেখতে আসেন এবং তাকে বোঝাতে থাকেন, যেন তিনি অনশন ভাঙেন। কিন্তু আখতার তার অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েননি। বলেছেন, মেধাবীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কীভাবে থাকবে? পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি অনশন চালিয়ে যাবেন। ওইদিন তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তাকে ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে তার চিকিৎসা চলছিল। এর আগে তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, বামপন্থী ছাত্রসংগঠন প্রগতিশীল ছাত্রজোট এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনে গড়ে ওঠা সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। তারা পরীক্ষা বাতিল ও পুনঃপরীক্ষার দাবি জানিয়ে বক্তব্যও দেন রাজু ভাস্কর্যে।
‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিল করা, পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া, প্রশ্নফাঁসে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং জালিয়াতি করে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের ভর্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে এ ক’দিনে একাধিক মিছিল অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা একের পর এক আল্টিমেটাম জানাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন আখতার হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত জানার পর বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এটি মনে রাখবে এবং ভবিষ্যতে প্রশ্ন যাতে আর ফাঁস না হয় সে জন্য এ সিদ্ধান্তটি বাধা হিসেবে কাজ করবে।’ তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশি হয়েছি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ভুল বুঝতে পেরেছে। প্রশাসন এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে যে আসলে প্রশ্নফাঁস হয়েছে এবং জালিয়াতি করে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে দেওয়া উচিত নয়।’

 
Electronic Paper