ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

টেকসইয়ে বাধা ব্যবস্থাপনা

জাফর আহমদ
🕐 ১০:৩৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০১৮

খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের সফলতা অর্জন হলেও তা টেকসই হচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে একটি ফসল নষ্ট হয়ে গেলে পরের বছর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আর ঘাটতি মেটাতে আমদানি করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য। এই সাময়িক ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে খাদ্যশস্যের দাম একবার বেড়ে গেলে ওই দামই স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।

এতে কম আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর হাওর ও উত্তরাঞ্চলে আগাম বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়া এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে বিপুল  পরিমাণ খাদ্য আমদানি ও বাজারদর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।  
খাদ্য উৎপাদন হওয়ার পরও তা টেকসই নিরাপত্তা সৃষ্টি করতে পারছে না। আর এর পেছনে খাদ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি কাজ করছে বলে মনে করেন বিআইডিএসের গবেষক ড. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, আমাদের যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন তা উৎপাদন হচ্ছে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগও আমাদের সঙ্গী। একটি ফসল নষ্ট হলেই ধাক্কা লাগছে। এ জন্য খাদ্যের সঠিক তথ্য ও আপদকালীন মজুদ রাখতে হবে। দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্বলতা আছে। গত বছর আগাম বন্যায় হাওর ও উত্তরাঞ্চলের ধান নষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে।
দেশে বর্তমান প্রতি কেজি চিকন চালের কেজি ৬০ থেকে ৬২ টাকা; মধ্যম ধরনের বিআর-২৮ চালের কেজি বাজার ভেদে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এ চালগুলো মূলত মধ্যম ধরনের চাল। আর মোটা চাল বলে পরিচিত ইরি জাতের বিভিন্ন রকম চালের কেজি ৪০ টাকা থেকে বাজার ভেদে ৪৪ টাকা। কিন্তু এই চালই ২০১৭ সালের বন্যার আগে ১৫ থেকে ২০ টাকা কম দামে বিক্রি হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চের দিকে হঠাৎ বন্যায় হাওর ও উত্তরাঞ্চলের ধান ডুবে গেলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। চিকন চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা; মধ্যম ধরনের বিআর-২৮ চালে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা; আর মোটা চালের দাম ৫০ ছুঁইয়ে ফেলে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে গত কয়েক বছরে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থেকে থেকে যাচ্ছিল। ফলে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের দাম নিশ্চিত করতে সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানিতে লাগাম টানে। চালের ওপর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ করে। খাদ্যশস্য আমদানিতে যখন ৫ শতাংশ শুল্ক ছিল তখন প্রয়োজন ছাড়াও আমদানিকারকরা চাল আমদানি করত। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আমদানি হয় ১৫ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। এরপর বাড়তি শুল্কারোপের পর দেখা যায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল আমদানি হয় ৪ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন। এ সময়ে শুধু  উন্নত মানের চালই আমদানি হতে থাকে। এরপর বন্যায় ধান নষ্ট হওয়ায় শুল্ক প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। দুই বছর পর পর যথাক্রমে ১০ ও ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি বেড়ে যায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয় ১৮ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয় ৪২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন। অথচ কৃষি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন। বন্যায় নষ্ট হওয়া ধানের কয়েকগুণ চাল আমদানি করলেও চালের দাম কমেনি।  
ড. আসাদুজ্জামানের মতে, ২০১৭ সালের বন্যার পর ধানের ক্ষতির সঠিক তথ্য ছিল না। কোনো কারণে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত মজুদও ছিল না। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে খাদ্য নষ্ট হওয়ার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দক্ষতার পরিচয় দেওয়া যায়নি। এ অফিস থেকে অন্য অফিসে ফাইল চালাচালি করতে দুই-তিন মাস দেরি হয়ে গেছে। আর এর মধ্যে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে।
গত কয়েক বছরে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অসামান্য সাফল্য দেখিয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এই সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য দেশে উৎপাদন হতো না। এরপর চার দশকে মানুষ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি বা দ্বিগুণের বেশি। আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন। অর্থাৎ তিনগুণ বেশি। এর মধ্যে রয়েছে- গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রকম খাদ্যশস্য। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে আবহাওয়ার অনুকূলে থাকা এবং মাঠ পর্যায়ে সরকারের কৃষি বিভাগের তৎপরতায় কৃষক ভালো বীজ, জমিতে সুষম সারের ব্যবহার বৃদ্ধি ও পরিমিত সেচের কারণে বর্তমানে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষি গবেষকদের মতে, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রধান ফসল ধানের আবাদ ঠিক রেখে গম, ভুট্টা, ডাল, তৈল, সবজি ইত্যাদি আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। এটা করা গেলে দেশের বর্ধিত মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করা যাবে।  
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, খাদ্য উৎপাদেন পাশাপাশি সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য সঠিক বাজারজাত ও মানুষের জন্য কাছে সঠিক সময়ে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে খাদ্যের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদকের যেমন স্বার্থ দেখতে হবে তেমনি ভোক্তার স্বার্থও নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তা বা চাষিরা কেউই যেন মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুদারের অধিক মুনাফার লালসার শিকার না হন।  

 
Electronic Paper