ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

১১ মাসে সড়কে মৃত্যু ৭৩৭ শিক্ষার্থীর

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৬, ২০২১

১১ মাসে সড়কে মৃত্যু ৭৩৭ শিক্ষার্থীর

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই গত কয়েক দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকায় তিন শিক্ষার্থী মারা গেছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১১ মাসে সারা দেশে ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৩৭ জনই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। সে হিসাবে দুর্ঘটনাগুলোতে নিহতদের ১৪ শতাংশই শিক্ষার্থী। শুধু গত নভেম্বর মাসেই সড়কে প্রাণ গেছে ৫৪ ছাত্রছাত্রীর।

 

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রোববারও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অব্যাহত ছিল। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিয়ে মানববন্ধন, কফিন মিছিল ও ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সোমবার রামপুরা ব্রিজে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করবেন তারা। শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ এবং মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানাবেন।

১১ মাসে ৪২৬৮টি দুর্ঘটনায় ৫১৪৪ জনের প্রাণহানি :

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৪৪ জন। নিহতদের মধ্যে ১৪ শতাংশই শিক্ষার্থী। গত ১১ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে ৭৩৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৭৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৮৩, মার্চে ৭২, এপ্রিলে ৬৪, মে মাসে ৮৪, জুনে ৫৩, জুলাইয়ে ৬৮, আগস্টে ৬২, সেপ্টেম্বরে ৬০, অক্টোবরে ৫৮ এবং গত নভেম্বর মাসে ৫৪ শিক্ষার্থী মারা যান।

নভেম্বরে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৩ মৃত্যু : রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, গত নভেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭৯টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। সারা দেশে সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৩ জন, আহত হয়েছেন ৫৩২ জন। এর মধ্যে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪৪.৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১.৬৮ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৩.২৪ শতাংশ। এছাড়া নভেম্বরে ৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং ৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছেন।

সংস্থাটি আরও জানায়, সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৫৬টি (৪১.১৬ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৩১টি (৩৪.৫৬ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৫৩টি (১৩.৯৮ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৩৫টি (৯.২৩ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৪টি (১.০৫ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাগুলোর ৮৯টি (২৩.৪৮ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৩৩টি (৩৫.০৯ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৯১টি (২৪ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৫৯টি (১৫.৫৬ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৭টি (১.৮৪ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঢাকায় :
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬.৫৭ শতাংশ, প্রাণহানি ঘটেছে ২৬.৫১ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৯৪ শতাংশ, প্রাণহানি ১৩.৪২ শতাংশ; চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯.৩২ শতাংশ, প্রাণহানি ২১.৮১ শতাংশ; খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.১৭ শতাংশ, প্রাণহানি ৭.৭১শতাংশ; বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.২১ শতাংশ, প্রাণহানি ৬.০৪ শতাংশ; সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.২৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৭.০৪ শতাংশ; রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৭৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৯.৭৩ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.১৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৭.৭১ শতাংশ ঘটেছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন :
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব সাইদুর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশে বিভিন্ন বিষয়ে আইন আছে; কিন্তু আইনের প্রয়োগ সব সময় হয় না। গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা মানে না চালকরা। এক্ষেত্রে গাড়ি চালানোর সময় চালক ফোন ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক জরিমানা করার জন্য ট্রাফিক পুলিশের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন করে যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চালকদের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষিতরাই শুধু পেশাদার চালক হিসেবে বিশেষ করে যাত্রীবাহী ও ভারী যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে। মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।

আজ শিক্ষার্থীদের কালো ব্যাজ ধারণ-মোমবাতি প্রজ্বলন :
নিরাপদ সড়কের দাবিতে রামপুরা ব্রিজে টানা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল রোববার মানববন্ধন ও ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা। ব্যঙ্গচিত্রে সড়কে চলমান অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তারা। এ কর্মসূচি শেষ করার আগে শিক্ষার্থীরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। নতুন কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সোমবার শিক্ষার্থীরা দুপুরে রামপুরা ব্রিজে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করে কালো ব্যাজ ধারণ করে এবং মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করার কথা রয়েছে।

এদিকে নিরাপদ সড়কসহ ৯ দফা দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে রোববার দুপুরে প্রতীকী কফিন মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে কিছু সময় অবস্থানের পর মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ের দিকে যান আন্দোলনকারীরা। সেখানে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা করে দুপুর দেড়টার দিকে আন্দোলন সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী আজ সোমবার সন্ধ্যায় জাতীয় শহীদ মিনারের সামনে মোমবাতি প্রজ্বলন ও গানের আসরের কর্মসূচি পালন করবেন তারা।

অবশেষে সব সিটিতেই হাফ ভাড়ার ঘোষণা :
শিক্ষার্থীদের কঠোর আন্দোলনের মুখে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো দেশের অন্য মেট্রোপলিটন ও জেলা শহরে ‘সিটি সার্ভিস’গুলোতে হাফ ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু শর্তও নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ১১ ডিসেম্বর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

গতকাল রোববার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, হাফ ভাড়া শুধু সিটি সার্ভিসে কার্যকর হবে। কোনো অবস্থায় আন্তঃজেলা বা দূরপাল্লার বাসে কার্যকর হবে না। গ্রামের ছাত্রদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সারা দেশের সিটির মধ্যে হাফ ভাড়া কার্যকর হবে, এর বাইরে নয়। আশা করি এ ঘোষণার পর ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবে। তারা পড়ালেখায় মনোযোগী হবে।

 
Electronic Paper