নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন নিখোঁজ ত্ব-হা
প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৮, ২০২১
আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান নিখোঁজের আট দিন পেরিয়ে গেছে। কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছেÑতা জানতে উদগ্রীব হয়ে আছেন মা আজেদা বেগম। ত্ব-হা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করত না। তার কোনো শত্রু ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলের সন্ধান চাই। আমার বুকে ওকে ফিরে পেতে চাই।’
ত্ব-হার মা দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার আগেও আমার ছেলে জানিয়েছিল তাকে দুজন ব্যক্তি অনুসরণ করছে। এটা নিয়ে আমি এমনিতেই চিন্তায় ছিলাম। ১০ তারিখে যখন ও ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় তখন হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করে। নামাজ পড়ে দোয়া করতে বলে।’
আজেদা বেগম আরও বলেন, ‘ত্ব-হা ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ও মেধাবী। সব সময় খেলাধুলা আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। রাজনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। পড়াশোনা শেষে ইসলামের প্রচার-প্রসারে মনোনিবেশ করে। বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় ওয়াজের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের বক্তব্য প্রচার করত। তার কোনো শত্রু থাকতে পারে না।’
ত্ব-হার বোন রিতিকা রুবাইয়াত ইসলাম খোলা কাগজকে বলেন, ‘ভাইকে দুজন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে কয়েক দিন ধরে ফলো করছিল। ভাই বিষয়টি সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, যে ঢাকায় গেলে নিরাপদে থাকবেন।’
নিখোঁজ হওয়ার তারিখ নিয়ে বিভ্রাট : ইসলামী বক্তা হিসেবে পরিচিত আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান প্রায় আট দিন ধরে তিন সঙ্গীসহ নিখোঁজ রয়েছেন। কিন্তু তার নিখোঁজ হওয়ার দিন-তারিখ নিয়ে বিভ্রাট দেখা দিয়েছে।
ত্ব-হা দুই বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম আবিদা নুর। সেই সংসারে তিন বছরের একটি মেয়ে ও দেড় বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। কয়েক মাস আগে আদনান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার সারা ঢাকার মিরপুর আল ইদফান ইসলামী গার্লস মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক।
এরই মধ্যে স্বামীর খোঁজে স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পুলিশ সদর দফতর, র্যাব সদর দফতরÑসব জায়গাতেই অভিযোগ করেছেন ত্ব-হার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাবিকুন্নাহার যে চিঠিটি জমা দিয়েছেন, তাতে তিনি লিখেছেন, গত ৮ জুন রংপুর থেকে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো গ ৩৩-৪৩৪২) ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন ত্ব-হা। তার সঙ্গে ছিলেন আব্দুল মুহিত, মোহাম্মদ ফিরোজ ও গাড়িচালক আমির উদ্দীন ফয়েজ। গাড়িসহ চারজনেরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
অথচ ত্ব-হার মা আজেদা বেগম গত ১১ জুন রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় যে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন, তাতে তিনি অভিযোগ করেন ত্ব-হা ১০ জুন রংপুর থেকে বিকাল ৪টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। সেদিন রাত থেকেই তার ফোন বন্ধ। এরপর খোঁজ না পেয়ে তারা নিশ্চিত হন ত্ব-হা নিখোঁজ। ত্ব-হার স্ত্রীর আকুতি
গত বুধবার স্বামীর সন্ধান চেয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন ত্ব-হার দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘ত্ব-হা নিরীহ মানুষ। হয় তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন, নয়তো আমাকে তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দিন। তিনি কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি না আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও কওমি, না আহলে হাদিস। সাধারণ একটা মানুষ।’
একপর্যায়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন ত্ব-হার স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি এভাবে জীবন চালাতে পারছি না। আমি প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে গেছি। হাতজোড় করে বলব, এই নিউজটা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে দিন। উনি যেন অতিসত্বর ত্ব-হাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন।’
একইদিন গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘ধর্মীয় বক্তা আবু ত্ব-হা আদনানের বিষয়টি সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।’
সন্ধানে কাজ করছে গোয়েন্দা পুলিশও : আবু ত্ব-হা নিখোঁজের ঘটনার তদন্তে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশও কাজ করছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ত্ব-হাসহ চারজন ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, এটা আমরা জেনেছি। আমরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলছি। একটা জিডি হয়েছে রংপুরে। রংপুর থেকে কাজ চলছে। আমরাও কাজ করছি। একই সঙ্গে কয়েকটি ঘটনা, একটু সময় লাগতে পারে।’
রংপুর পুলিশ যা বলছে : ত্ব-হা নিখোঁজের ঘটনায় তার মা রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় যে জিডি করেছেন, তার তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন, যে প্রাইভেট কারে ত্ব-হাসহ চারজন ঢাকায় যাচ্ছিলেন সেটি তার নিজস্ব ছিল। তবে ওই কারটি মাঝে-মধ্যে ভাড়ায় চালিত হতো। তদন্তের বিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ‘সব ধরনের কারণ ও সন্দেহ মাথায় রেখে তদন্ত কাজ চলছে। তবে এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
কে এই আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান : উত্তরের অক্সফোর্ড-খ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন ত্ব-হা। সেখান থেকে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এর আগে রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পড়ালেখার পাশাপাশি প্রচুর ইসলামিক বই পড়তেন ত্ব-হা। গবেষণা করতে করতে দর্শনশাস্ত্রে পড়া এই যুবক হয়ে ওঠেন ইসলামী বক্তা। আরবি শিক্ষার জন্য স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় কিছুদিন তালিম নেন তিনি।
অনলাইনে আরবি পড়ানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে ত্ব-হা জুমার খুতবা দিতেন বলে জানান পরিবারের সদস্যরা। ধর্মীয় বক্তা হিসেবেও পরিচিত; তার ফেসবুকে পেজের অনুসারীর সংখ্যা ৫২ হাজার।
ত্ব-হা সদা হাস্যোজ্জ্বল ও মিশুক ছিলেন। বই-খাতার সঙ্গে যেমন নিবিড় সম্পর্ক ছিল, তেমনি ক্রিকেটের প্রতিও ছিল গভীর টান। স্কুলজীবন থেকে ভালো খেলতেন। রংপুরের ক্রিকেট অঙ্গনে ছিল তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। শুধু ক্রিকেটই ভালো খেলতেন তা নয়, আদনানের হাতের ছোঁয়া ছিল গিটারেও। তার অসাধারণ গিটার বাজানো বিমোহিত করত স্থানীয়দের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাট-বল, গিটার ছেড়ে আদনান নিজেকে ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে নেন। হয়ে ওঠেন তরুণ ইসলামী আলোচক ও বক্তা।