ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনার দাপটে হোঁচট খাচ্ছে টিকা কূটনীতি

সাজেদ রোমেল
🕐 ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০২১

করোনার দাপটে হোঁচট খাচ্ছে টিকা কূটনীতি

রূপ পাল্টে আগ্রাসী ভূমিকায় করোনাভাইরাস। বিশ্বজুড়ে মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়িয়ে চলেছে। এর মধ্যে ভারতের পরিস্থিতি আরও খারাপ। বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারীও দেশও ভারত। ফলে গত মার্চের শেষ দিকে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয় দেশটি। বাংলাদেশকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার নিশ্চয়তা দিয়ে ভারত যেভাবে টিকা কূটনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে পেছনে ফেলেছিল, তা আর ধরে রাখতে পারছে না। এরই মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট। তারা জানিয়ে দিয়েছে, ভারত সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় বাংলাদেশ টিকা পাঠানো যাচ্ছে না। এদিকে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী চীন। টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তারাও সক্রিয় হতে পারছে না টিকা কূটনীতির ময়দানে। অন্যদিকে টিকা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনীতিতে নামার ইঙ্গিত মিলছে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরাশক্তি- রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের।

করোনায় বিপর্যস্ত ভারত ঘর সামলাতেই ব্যস্ত : গতকাল রোববার সকালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ ছাড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার আর একদিনে মারা গেছে দেড় হাজারের বেশি মানুষ। দিল্লিতে কারফিউ চলছে, সেখানে কবরের জায়গাও নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আমরা টাকা নিয়ে বসে আছি, কেন্দ্র টিকাও দিতে পারছে না, আমরা যে বাইরের কোনো দেশ থেকে আনব, তারও অনুমতি দিচ্ছে না কেন্দ্র।’ শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, মহারাষ্ট্রসহ অনেক রাজ্যই জানিয়েছে, তাদের টিকার মজুদ শেষ হবে এক সপ্তাহের মধ্যে।

এদিকে যথাসময়ে টিকা দিতে না পারায় সেরামকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত টিকার বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা। দরিদ্র দেশকে স্বল্পমূল্যে কোভ্যাক্সের টিকা না দিতে পারায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও চাপে আছে সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালা চলতি মাসের শুরুর দিকে গণমাধ্যমকে জানান, ভারতে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় ‘সেরামের কোভিশিল্ড উৎপাদন কার্যক্রম খুবই চাপের মুখে রয়েছে’।

বাংলাদেশের খারাপ পরিস্থিতিতে নীরব চীন : ভারতই টিকা দিচ্ছে- ডিসেম্বরে যখন চূড়ান্ত হলো, তখন থেকে টিকা কূটনীতির দৌড়ে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না চীনের। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর তারা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে টিকা সরবরাহে মন দেয়। বাংলাদেশে করোনা বাড়ার পরিস্থিতিতে ভারত টিকা দেওয়ার বন্ধ করে দেয়। এমন অবস্থায় চীনেরও কোনো তৎপরতা নেই।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চীন থেকে টিকা আনার কোনো উদ্যোগ চূড়ান্ত হয়নি।’

বাংলাদেশে টিকা কূটনীতির নতুন দুই আগুন্তক : বাংলাদেশের টিকা আমদানির বিষয়টি কূটনীতির পর্যায়ের যাওয়ার আগে বা পরে যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের দেশে উৎপাদিত জনসন অ্যান্ড জনসন, মডার্না বা অন্য কোনো ব্র্যান্ডের নাম শোনা যায়নি। বিষয়টি সামনে আসে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ দূত জন কেরির বাংলাদেশ সফরের সময়। সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্যে সাক্ষাতে রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে জুড়ে দেন টিকার বিষয়টি। বলেন, ‘বাংলাদেশ চাইলে আমরা আমাদের দেশে উৎপাদিত টিকা দিতে পারি।’ টিকা কূটনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচমকা আগমন হলেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র রাশিয়ার অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। যদিও তাদের টিকা স্পুুটনিক নিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আগ্রহ আছে বিস্তর। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত সপ্তাহে বলেন, ‘আমরা টিকা সংগ্রহের বিকল্প উৎস খুঁজছি।’

সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় টিকা দিচ্ছে না সেরাম : সেরামের টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তাদের থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের পরবর্তী চালান দেশে আসার বিষয়ে সরকারও সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান হারে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হতে থাকলে মজুতে থাকা ভ্যাকসিন আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

বর্তমানে দৈনিক প্রায় দুই লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রথম ডোজ নিচ্ছেন। দেশে মজুত থাকা এক কোটি দুই লাখ ডোজ ভ্যাকসিনের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে সেরামের স্থানীয় এজেন্ট বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন গত শুক্রবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা সেরামের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। সেরাম জানিয়েছে, তারা টিকা রপ্তানি করতে প্রস্তুত। তবে ভারত সরকারের ছাড়পত্র প্রয়োজন। সেরাম এখনো সে ছাড়পত্রটি পায়নি।’

সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে মোট ছয়টি চালানে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার জন্য চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় চালানে ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আসে। তৃতীয় চালানের ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন মার্চের শেষ সপ্তাহে আসার কথা থাকলেও পাওয়া যায়নি।

টিকা কূটনীতির চালকের আসনে নেই বাংলাদেশ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিকল্প হাতে না রাখায় চালকের আসনে নেই বাংলাদেশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চীন ও ভারতের কূটনীতিকরা সমানতালে দৌড়েছে বাংলাদেশের পেছনে। অগ্রিম টাকা দিয়ে সেরামের সঙ্গে তিন কোটি টিকার চুক্তির পর পিছিয়ে যায় চীন আর ভারত সরকারও হাফ ছেড়ে বাঁচে। তবে ভারতে সংক্রমণ মারাত্মক পরিস্থিতিতে যাওয়ার আগেই চুক্তি ভঙ্গ করে সেরাম। প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে টিকা দেওয়ার কথা। জানুয়ারিতেই তারা এ পরিমাণ টিকা পাঠায়। ফেব্রুয়ারিতে ভারতে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। সে মাসেও ৫০ লাখের বদলে টিকা এসেছে ২০ লাখ। মার্চে কোনো টিকাই আসেনি। অথচ ভারতে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে মাসের শেষদিকে।

টিকাদান কর্মসূচিতে বিঘœ ঘটবে কি না, জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। যদি সেরামের কাছ থেকে দ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়া না যায়, তাহলে আমরা অন্যান্য উৎস থেকে একই ভ্যাকসিন জোগাড় করার চেষ্টা করব।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানিয়েছে, এখন প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজে একই সঙ্গে চালানো বড় চ্যালেঞ্জ। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় ডোজগুলো দেওয়া যাবে কি না, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন নেই।

 
Electronic Paper