গণপরিবহনে বাড়ছেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা
প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ০৮, ২০২১
রাজধানী ঢাকার সড়কে গণপরিবহনের গাড়ির ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা জনসাধারণের মনে মারাত্মক ভীতির সঞ্চার করছে। বেশ কয়েকটি আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো প্রায়শই ঘটে চলেছে বাসগুলোর রেষারেষির ঘটনা। ফলে ঘটছে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা, ঘটছে প্রাণহানি। আবার হাত-পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই।
সবশেষ গতকাল রোববার রাজধানীর গুলিস্তানে মোড় ঘোরার সময় প্রতিযোগিতায় থাকা দুটি বাসের মাঝখানে চাপা পড়ে প্রাণ হারান পারভীন বেগম (৪০) নামে এক নারী। ওই দুর্ঘটনায় তার মেয়ে সুরাইয়া আহত হন।
পুলিশ জানায়, দুপুরে গোলাপ শাহ মাজার সংলগ্ন রাস্তায় ‘এন মল্লিক’ ও ‘আরাম পরিবহন’ নামে দুটি বাস ইউটার্ন নেওয়ার সময় সড়কে পাল্লাপাল্লি করতে থাকে। এ সময় পারভীন ও তার মেয়ে দুই বাসের মাঝখানে পড়ে যান। দুই বাসের চাপায় পারভীন বেগম গুরুতর আহত হন। তার মেয়েও সামান্য আহত হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পারভীনকে মৃত ঘোষণা করেন।
শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মামুন অর রশিদ দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, প্রতিযোগিতা করা বাস দুটো জব্দ করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি বাসের চালককে আটকও করা হয়েছে।
নিহত পারভীন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রাজদিয়া গ্রামের আব্দুল বাসেরের স্ত্রী। তাদের দুই মেয়ে রয়েছে। নিহতের স্বামী আব্দুল বাসের বলেন, আমার মেয়ে সুরাইয়া অসুস্থ। তার মা তাকে ডাক্তার দেখাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তার দেখানোর পর গুলিস্তানে আসেন। গুলিস্তান থেকে আরেকটি বাসে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেবেন বলে গোলাপশাহ মাজারের পাশ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। এমন সময় দুটি বাসার চাপায় পড়েন তারা।
অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বাড়ছে প্রাণহানি
ঢাকার রাস্তায় দুই বাসের প্রতিযোগিতায় এমন প্রাণহানি নতুন কিছুই নয়। গুলিস্তানে ওই সড়ক দুর্ঘটনার পর স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই সড়কে প্রায় প্রতিদিনই বেপরোয়াভাবে বিভিন্ন কোম্পানির বাস যাত্রী তোলার জন্য রেষারেষি ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে থাকে। এক বাস আরেক বাসকে পিছনে ফেলে আগে গিয়ে যাত্রী তুললে দুটি বাসই বেপরোয়া গতিতে এগিয়ে যায়। এতে অনেক সময় দুই বাসের মাঝখানে পড়ে পথচারী বা মোটরসাইকেল আরোহীরা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার শিকার হন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে সড়কে ৪ হাজার ৮৯১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত এবং ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন।
এর আগে গত ২ মার্চ রামপুরায় ফ্লাইওভারের গোড়ায় আবুল হোটেলের সামনে রাইদা পরিবহনের দুটি বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় প্রাণ হারান নাজমুল হোসেন নামে এক কিশোর। সে একটি বাসের চালকের সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করত। ৫ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে তিন পথচারী নিহত হন।
গত বছরের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় প্রাণ হারান ওমর ফারুক তুহিন (২৮) নামের এক মোটরসাইকেল চালক।
২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পিছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। তার হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পিছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়া বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ-দিকে গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১৭ এপ্রিল মারা যান তিনি। এ ঘটনা মানুষের মনে দাগ কাটে।
একই বছরের ২৯ মে দুই বাসের চাপায় পড়ে কোনাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে প্রাণ যায় রামচরণ সরকার নামের এক বাস হেলপারের। ঢাকাগামী আজমেরী ও গ্লোরী পরিবহনের দুটি বাস পাল্লা দিয়ে যাওয়ার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এরপর ২৯ জুলাই রাজধানীর হোটেল র্যাডিসনের বিপরীত পাশের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের ঢালের সামনের রাস্তায় জাবালে নূর পরিবহনের তিন বাসের রেষারেষির সময় একটি বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের উপর উঠে পড়ে। এতে শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব (১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬) মারা যান। আহত হন ৯ জন। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত কোম্পানি ভিত্তিক বাস সার্ভিস পরিচালনা না করা হবে ততদিন পর্যন্ত বাসগুলোর প্রতিযোগিতা ঠেকানো যাবে না। আমরা অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি যে কোম্পানি ভিত্তিক বাস পরিচালনা করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। আশা করছি সরকার এদিকে নজর দিবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বাসের এই জীবনঘাতী প্রতিযোগিতা বন্ধ করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, এখন বাসগুলো পরিচালিত হচ্ছে ইজারার ভিত্তিতে। এতে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় পরিবহন শ্রমিকদের বেতন, পরিচালনা খরচ, মালিকের মুনাফার ওপর নির্ভর করে। সে হিসাবেই বাসচালক ও হেলপারদের দৈনিক ইজারায় বাস তুলে দেওয়া হয়। ফলে তারা যাত্রী ধরার জন্য এক বাস আরেক বাসের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে থাকে। এতে মানুষের জীবন চলে যায়, দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু তাদের কিছুই যায় আসে না। তাদের লক্ষ্য থাকে কে কার থেকে বেশি যাত্রী ধরবে। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হলো চালক ও হেলপারদের মাদক সেবন। ২০০১ সালে চালকদের ডোপ টেস্ট করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন অনেকেই এ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। যখন অধিকাংশ চালক মাদকাসক্ত এটা প্রমাণ হলো, তখন ডোপ টেস্টের বিষয়টি আলোচনায় এলো।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের ১১১টা পরামর্শ রয়েছে। সরকার এগুলো বাস্তবায়ন করলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনারোধে আমাদের তেমন কোন প্রচার-প্রচারণা নেই। সড়ক আইন নিয়ে প্রচারণা না চালালে এটা নিয়ে মানুষ সচেতন হবে কীভাবে? মানুষের মধ্যে সচেতনতা না আসা পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।