ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্বজনের কান্না থামেনি

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের একযুগ

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১

স্বজনের কান্না থামেনি

ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে নৃশংস হত্যাকা-ের দীর্ঘ এক যুগ পার হলো গতকাল বৃহস্পতিবার। দিনটিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে বনানীর সামরিক কবরস্থানে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনরা। হত্যা মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা ও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। একই সঙ্গে হত্যাযজ্ঞের পেছনে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে বিচারিক তদন্ত কমিশন গঠনেরও দাবি জানায় নিহতদের পরিবার।

এ সময় পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহত কর্নেল কুদরত এলাহি রহমান শফিকের ছেলে সাকিব রহমান দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, এক যুগ আগে যখন ওই নৃশংস ঘটনা ঘটে, তখন আমার বয়স মাত্র ১৮ বছর। আমি তখন ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের সাভার ক্যাম্পাসে ছিলাম। খবর পেলাম পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছে। তখন ভেবেছিলাম জিম্মি করে কিছু ডিমান্ড করবে ওরা। বুঝতে পারিনি এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞ ঘটতে চলেছে। দুই দিন বাবার কোনো খবর পাইনি।

২৭ ফেব্রুয়ারি সিএমএইচে লাশ দেখে নিশ্চিত হই আমার বাবা আর নেই। তিনি আরও বলেন, পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর আরও তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো রায় কার্যকর হচ্ছে না। আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আমার দাবি, একটি জুডিশিয়াল এনকয়ারি কমিশন গঠন করা হোক। তাহলে ঘটনার পেছনের ষড়যন্ত্রকারী কারা, পর্দার আড়ালে কারা ছিলÑসবকিছুই বের হয়ে আসবে।

কবরস্থানে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল কুদরত এলাহি রহমানের ৮৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা হাবিবুর রহমানও। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় আক্ষেপ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ২৫ বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। ছেলে মারা গেল ২০০৯ সালে। এরপর একটা যুগ কেটে গেল। কোনো বিচার পেলাম না। ১২ বছরে মানুষের বিচার তো পাইনি, এখন আল্লাহর বিচারের অপেক্ষা করছি। এই নৃশংস ঘটনার বিচার আল্লাহই করবেন। আমার জানা মতে আমার সন্তান ছিল একেবারেই নির্দোষ ও নিরপরাধ।

পিলখানার ঘটনায় নিহত লে. কর্নেল লুৎফর রহমানের ভাই আখলাকুর রহমান ও এহতেশাম রহমান বলেন, এ দিনটিকে রাষ্ট্রীয় শোক ও ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তাহলে আগামী প্রজন্ম এই দিনটি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারবে। মেজর মোস্তফা আসাদুজ্জামানের ভায়রা আসলাম সেরনিয়াবাত বলেন, দ্রুত আলোচিত এই মামলার রায় বাস্তবায়ন হোক। তাহলেই নিহত সেনা কর্মকর্তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
এদিকে দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের। সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর বনানীতে সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সামরিক সচিব। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পরে শ্রদ্ধা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এরপর তিন বাহিনীর প্রধান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এক যুগ আগে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর (বর্তমান নাম বিজিবি) সদর দফতর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু সদস্য। তারা পিলখানায় নারকীয় হত্যাকা- চালান। নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যও। দুদিনব্যাপী ওই বিদ্রোহ শেষে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
হত্যা মামলাটি আইনি লড়াইয়ের চূড়ান্ত ধাপে

নৃশংস হত্যা মামলাটি এখন আইনি লড়াইয়ের চূড়ান্ত ধাপে। তবে এ বিস্ফোরক আইনে করা মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতের গ-ি পেরোয়নি। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর দ-াদেশের বিরুদ্ধে ২০৪ জন আসামি পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছেন। খালাস পাওয়া ও সাজা কমা ৮৩ আসামির ক্ষেত্রে ২০টি লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এখন এসব আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির অপেক্ষায়। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি সবচেয়ে বড় মামলা।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আগামী মাসে লিভ টু আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। অবশ্য আসামিপক্ষের মতে, আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া ও প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে চলতি বছর আপিল ও লিভ টু আপিলের ওপর শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। ‘পিলখানা হত্যা’ মামলা হিসেবে পরিচিত ওই মামলায় আসামি ছিলেন ৮৫০ জন। বিচারিক আদালতের রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদ-, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- অনুমোদন) হাইকোর্টে অনুমোদনের জন্য আসে। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২২৮ জনকে। যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ অন্যরা খালাস পান।

হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর গত ডিসেম্বর ও চলতি বছর রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করে।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ গত ডিসেম্বরে লিভ টু আপিল দায়ের করেছে। আসামিপক্ষ সরাসরি কয়েকটি আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করেছে। লিভ টু আপিল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। লিভ টু আপিলগুলো আগামী মাসে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

বিস্ফোরক মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে
বিস্ফোরক আইনে করা মামলার বিচার এক যুগেও শেষ হয়নি। এ মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৩ ও ২৪ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে। বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ আসামি ইতিমধ্যে মারা গেছেন এবং ২০ আসামি পলাতক। ৭৮১ আসামি কারাগারে।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, গত বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিচারকাজ স্থগিত ছিল। বছরের শেষভাগে আবার কার্যক্রম শুরু হয়, যা চলমান আছে। চলতি বছরেই মামলাটি নিষ্পত্তি হতে পারে।

 
Electronic Paper