ভয়াল-কলঙ্কের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার
অপেক্ষার শেষ ১০ অক্টোবর
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহতম বোমা হামলা ও হত্যা মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে।
আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন ১০ অক্টোবর। ১১৯ কার্য দিবসে মামলার যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এ তারিখ নির্ধারণ করেন।
রায়ের দিন ধার্য করার পাশাপাশি এ মামলায় জামিনে থাকা তিন সাবেক আইজিপিসহ আট আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। এ সময় আদালত বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর এ মামলার বিচারের শেষদিকে আমরা এসেছি। এ মামলার বিচারে কোনো ফাঁক রাখার চেষ্টা করিনি। কখনো কারও অধিকারবঞ্চিত করিনি।’
পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। আসামিদের জামিন বাতিলের ব্যাপারে আদালত বলেন, ‘আসামিরা জামিনে থাকলে বিচারে সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্য আসামিদের জামিন বাতিল করা হলো।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো ভয়াল গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন। হামলার মূল টার্গেট ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সে দিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। দলের নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে তাকে বাঁচিয়েছিলেন। সে ঘটনায় আহত হয়েছিলেন কয়েকশ নেতাকর্মী; যারা এখনো শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।
তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম এ গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের সরকার ও ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সুষ্ঠু বিচারের পরিবর্তে এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। নোয়াখালীর সেনবাগের এক সাধারণ মানুষ জজ মিয়া; যে গুলিস্তানে সিডি বিক্রি করত তাকে ধরে নিয়ে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল প্রকৃত আসামিদের। গ্রেনেড হামলার কয়েক মাস পর গ্রামের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জজ মিয়াকে মালিবাগের কার্যালয়ে নিয়ে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে সাজানো জবানবন্দি দিতে বলা হয় তাকে। তার সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদেরও মেরে ফেলার হুমকি দেন তৎকালীন সিআইডির কর্মকর্তারা। বাধ্য হয়ে জজ মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন। পরে জজ মিয়ার আসল পরিচয় বেরিয়ে এলে বিএনপি-জামায়াত জোটের সাজানো নাটক ফাঁস হয়ে যায়।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন আদালতে সিআইডি’র দাখিল করা চার্জশিটে ২২ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় জজ মিয়াকে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এ-সংক্রান্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটির বিচার শুরু হয়। সে সময় ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। এ সময় নতুন করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে। ২০১১ সালের ৩ জুলাই আরও ৩০ জনসহ মোট ৫২ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে সিআইডি। এ অভিযোগপত্রে যুক্ত করা হয় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বখশ চৌধুরী এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত এএসপি আব্দুর রশিদ, অবসরপ্রাপ্ত এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমানের নাম।
দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। অন্য মামলায় তিন আসামি-জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুফতি হান্নান ও শরীফ সাইদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। এ মামলায় জামিনে ছিলেন আটজন; যাদের জামিন গতকাল বাতিল করেছেন আদালত। এ ছাড়া আগে থেকেই কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন।
গতকাল যুক্তিতর্ক ও শুনানির শেষ দিন লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীসহ ২৩ জনকে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে হাজির করা হয়। সাবেক তিন আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ জামিনে থাকা আট আসামিও ছিলেন আদালতে।
আদালত সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপক্ষের ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে মোট ২২৫ জন এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন। ১২১ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে মামলা দুটি রায়ের পর্যায়ে এলো। গতকাল রায় ঘোষণার দিন ধার্য হওয়ার পর মামলার সরকারি কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব শেষ করে দেওয়ার জন্য এ হামলা চালানো হয়েছিল। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।