গোল্ডেন মনিরের জালিয়াতি শুরু পুনর্বাসন প্রকল্প দিয়ে
প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:২৪ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২০
নব্বই দশকে গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের ভাগ্য হঠাৎ বদলে যায় ১০ বছরের মাথায়। ২০০১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং গণপূর্ত ও রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করে মনির রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০১ থেকে পরবর্তী ৫ বছরে মনির হয়ে ওঠেন ঢাকার শক্তিধর ভূমিদস্যুদের একজন। আর বর্তমানে তিনি দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। মনিরকে গ্রেফতার করার পর তার নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে, যা রীতিমতো বিস্মিত করে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। কীভাবে মনির এত ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন সেই তথ্যের অনুসন্ধানে নেমে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাড্ডার সাবেক কমিশনার এম এ কাইউম এবং বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ছোট ভাই সাবেক ডিসিসি কমিশনার মির্জা খোকনের হাত ধরে রাজউকে পদচারণা শুরু করেন গোল্ডেন মনির। মূলত তাদের আনুগত্যে আসার পরই রাজউকে প্লট কেনাবেচা ও নকশার দালালি শুরু করেন।
২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মির্জা আব্বাস পূর্তমন্ত্রী থাকার সময় বাড্ডা পুনর্বাসন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করার জন্য ২২ একর প্রকল্প নেয় রাজউক। তখন বাড্ডার সাবেক কমিশনার এম এ কাইউম ও মির্জা আব্বাসের ছোট ভাই মির্জা খোকন চার শতাধিক ক্ষতিগ্রস্তের ‘অ্যাওয়ার্ড সনদ’গুলো প্রভাব খাটিয়ে কিনে নেন নামমাত্র মূল্যে। এরপর প্লট বরাদ্দের জন্য অফিস স্থাপন করে সেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়। যেসব ক্ষতিগ্রস্ত ওই চক্রের সঙ্গে সমঝোতা করেনি, তাদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এভাবেই ওই সময় বাড্ডা ২২ একর প্রকল্পের দুই শতাধিক প্লট পান কাইউম কমিশনার ও গোল্ডেন মনির। ওয়ান-ইলেভেনের পর কাইউম কমিশনার দেশ থেকে পালিয়ে গেলে সব প্লটের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে মনিরের হাতে। পরবর্তীতে মির্জা খোকনেরও কিছু প্লটের দখল এসে পড়ে মনিরের হাতে। এভাবেই মনির হয়ে উঠেন একজন শক্তিধর ভূমিদস্যু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজউক ও দুদকের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্পের ২৮৩টি প্লট স্থানান্তর করে উত্তরা প্রথম পর্বে নিয়ে আসা হয়। এই প্লট স্থানান্তর নিয়েও বিশাল বাণিজ্য করেন গোল্ডেন মনির ও এ চক্রের অন্যরা। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যে ১০ হাজার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে সখ্যের সুবাদে সেসব প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বাণিজ্য করেন গোল্ডেন মনির। একপর্যায়ে রাজউকের বর্ধিতাংশ ভবনের পাঁচতলায় একটি অফিসও করেন মনির। রাজউকে শুরু হয় তার একচেটিয়া প্রভাব। পরিস্থিতি এমন হয় যে কেউ কোনো প্লট বিক্রি করতে গেলেই মনিরের শরণাপন্ন হতে হতো। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নিজের খোলস বদলে দলটির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন গোল্ডেন। রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন।
এর মধ্যেই গত বছরের ১৫ অক্টোবর রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান বর্তমানে বিদ্যুৎ সচিব ড. সুলতান আহমেদ রাজউকে শুদ্ধি অভিযান চালান। তখন ৭১টি প্লটের ফাইল মনিরের ওই কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকেই রাজউকে যাতায়াত কমিয়ে দেন মনির। তখন মনির ও রাজউকের অফিস সহকারী পারভেজসহ বেশ কয়েকজনের নামে মামলা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম বলেন, আমার ধারণা এটি এক দিনের প্রক্রিয়া নয়। এটা দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া। আমরা এতদিনে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। এগুলো আমরা তদন্ত করব। তদন্তে যারা শনাক্ত হবে, তাদের সবার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং আদালতে যে মামলা আছে তা চলবে।
রাজউক ভবনে মনিরের অফিসে অনেক কাগজপত্র পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে রাজউকের অনেকেই জড়িত- এ নিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, গত বছর রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন সুলতান আহমেদ। সে সময় আমি সদস্য (প্রশাসন) ছিলাম। আমাদের সবার অংশগ্রহণে একটি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল রাজউকেরই একটি কক্ষে। কক্ষটি বাইরে ভাড়া দেওয়া ছিল। এই কক্ষ থেকে আমরা ৭২টি নথি উদ্ধার করি। সেই নথি উদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে মতিঝিল থানায় মামলা করি।
স্ত্রীর নামেও বিপুল সম্পত্তির সন্ধান
গোল্ডেন মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তারের নামেও বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানা গেছে, মনির অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের একাংশ তার স্ত্রীর নামে রেখেছেন। রওশনের নামে ফ্ল্যাট, জমি, শেয়ার, এফডিআর, প্রাইজবন্ড, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাতে নগদ টাকা ও ব্যাংকে সঞ্চয়ের তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে। এছাড়া মনির ও তার পরিবারের তিন সদস্যের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
দুদক সূত্র জানায়, মনির ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে ২০১৬ সালে। সে সময় দুদকের নোটিস অনুযায়ী মনির ও তার স্ত্রী সম্পদের হিসাব পেশ করে কমিশনে। রওশন তার নামে স্থাবর এক কোটি ৯০ লাখ ৯৯ টাকার ও অস্থাবর দুই কোটি ৭৫ লাখ দুই হাজার ১৯৪ টাকার সম্পদের হিসাব কমিশনে পেশ করে। তবে তার নামে যে সম্পদ পাওয়া গেছে, তা প্রকৃত অর্থে অবাক করার মতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে মনিরের স্ত্রীর সম্পদের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। তিনি গৃহিণী, তার নামে থাকা পুরো সম্পদই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত। অনুসন্ধানে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়বে। তাই কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০১৬ সালের পর রওশনের সম্পদের হিসাব চেয়ে শিগগিরই আবার তাকে নোটিস পাঠানো হবে। সম্পদ বিবরণী পাওয়ার পর সেটা যাচাই-বাছাই করা হবে।