পিতা-পুত্রের থাবায় বহু বাড়ি-জমি
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৯, ২০২০
ছেলে ইরফান সেলিমের কারণে নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছেন ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম। অতীতেও নানা বিতর্কের কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এই সংসদ সদস্য। এই নেতার পেশিশক্তি ও আধিপত্যে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। বিশেষ করে লালবাগ, চকবাজার ও বংশাল এলাকায় একচ্ছত্র প্রভাব রয়েছে হাজী সেলিমের। লালবাগের বাদশা বলা হয়ে থাকে হাজী সেলিমকে। এ এলাকায় চলে তার নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা। নিজস্ব বাহিনী দিয়ে জমি, বাড়ি ও মার্কেট দখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদসহ চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। ঝামেলাপূর্ণ জমি দেখলেই তাতে দখলের থাবা বসাতন হাজী সেলিমের লোকজন। অসুস্থতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সেলিম সরাসরি তার দখল করা সাম্রাজ্যের দেখভাল না করতে পারায় বাবার হয়ে দেখাশোনা করছিলেন ছেলে ইরফান। এগুলো রক্ষায় তার রয়েছে প্রাইভেট বাহিনী।
লালবাগের এক বাসিন্দা বলেন, পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের বাইরে কেউ যেতে পারেন না। যে যান তাকে পড়তে হয় ওই এমপির রোষানলে। অসংখ্য জমি, বাড়ি, মার্কেট দখল করে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন হাজী সাহেব। এখন তিনি কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তার দখল করা এ সাম্রাজ্যের দেখাশোনা করে তার ছেলে কাউন্সিলর ইরফান। গতকাল বুধবার হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামার তথ্য জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের বলেন, এমপি হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফানের অর্জিত ও দখলি সম্পদগুলো যদি দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধে গণ্য হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করা হবে। সরকারের জায়গা বা সম্পত্তি হোক; যদি দখল হয় এবং দুদক আইনের আওতাভুক্ত হয়, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার হাজী সেলিম জাতীয় নির্বাচনে এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দল বিএনপি থেকে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দলটি থেকে মনোনয়ন নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান বিএনপি প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে।
মূলত ওয়ার্ড কমিশনার থাকার সময় থেকেই রাজধানীর লালবাগ, চকবাজারসহ পুরান ঢাকার একটি বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অন্তত ১২০টি মামলা দায়ের করা হয় হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। খুন, খুনের চেষ্টা, নির্যাতন, চুরি এবং দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ের কারণে এসব মামলা দায়ের করা হয়। নিজের বিভিন্ন অপরাধে সবসময় সহায়তা পেয়েছেন স্ত্রী গুলশান আরার। ২০০৮ সালের এপ্রিলে ২৭ কোটি টাকা জ্ঞাত বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের জন্য ১৩ বছরের জেল হয় সেলিমের। আর সেই সম্পদ নিজের কাছে রাখার জন্য ৩ বছরের জেল হয় তার স্ত্রী গুলশান আরার।
ইরফান গ্রেফতারের পর দখলমুক্ত হয় অগ্রণী ব্যাংকের জমি
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকায় অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ শতক জমি হাজী সেলিমের দখলে ছিল। নৌবাহিনী অফিসারকে মারধরের ঘটনায় গত সোমবার সেলিমের ছোট ছেলে ইরফান গ্রেফতার হলে অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের জায়গা দখলমুক্ত করে। সেদিন সন্ধ্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজেদের জায়গা বুঝে নেয়। এ সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ১৪ শতক এই জায়গার মালিক অগ্রণী ব্যাংক। যেখানে দোতলা একটি ভবন ছিল। স্বাধীনতার পরপরই এই শাখা উদ্বোধন করা হয়। সম্প্রতি পুরনো ভবন ছেড়ে রাস্তার সামনের দিকে স্থানান্তর করা হয় ব্যাংকটি। করোনাকালে অগ্রণী ব্যাংকের পুরনো দোতলা ভবন গুঁড়িয়ে দিয়ে জায়গাটি দখলে নেয় হাজী সেলিমের লোকজন।
বধির সমিতির জমি দখল
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লালবাগ থানা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা সরকারি বধির হাই স্কুলের এক একর জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। জমিটি দখলমুক্ত করতে গত বছর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ২০০৫ সালে বধির সংস্থাকে জায়গাটি বরাদ্দ দেয় সরকার। এরপর ২০০৭ সালে সেটি দখল করে নেয় হাজী সেলিম। আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কেউ এটি উদ্ধার করে দিতে এগিয়ে আসেনি।
আজও সেলিমের দখলে তিব্বত হল
পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেনে ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠা জায়গায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ‘তিব্বত হল’। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অর্পিত সম্পত্তি শাখার তথ্য অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলকৃত ১২টি হলের মধ্যে ‘তিব্বত হল’ একটি। এই হলটিও বর্তমানে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দখলে। ২০০১ সালে হলটির অবকাঠামো পরিবর্তন করে নিজের স্ত্রীর নামে ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’ নামক বহুতল বিপণী বিতান তৈরি করেন হাজী সেলিম। হলটি উদ্ধারে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় আন্দোলনে সরকারের উচ্চমহলের আশ^াসের পরেও আজও এটি বেদখলে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, এগুলো জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের মালিকানায় ছিল না। এগুলো হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি, ছাত্ররা এখানে থাকত। পুরনো হলগুলো নিয়ে যে মামলা মোকদ্দমা চলছে, তা জগন্নাথের সঙ্গে নয়। হলগুলোর মালিক হাজী সেলিমও না। সরকারের উচিত এগুলো উদ্ধার করা।
জিলাপিওয়ালার বাড়ি দখল
চকবাজার এলাকায় এক জিলাপি বিক্রেতার জমি রাতারাতি দখলের অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। এলাকাবাসী জানায়, ওই পরিবারকে রাতে তিনটি মাইক্রোবাস দিয়ে মদিনা টাওয়ারে তুলে নেয় হাজীর লোকজন। এরপর জোরপূর্বক তারা জিলাপিওয়ালার জমি লিখে নেয় এবং ওই পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে। এখনো এ খবর ওই এলাকায় প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে।
দখল করা জমিতে কোল্ড স্টোরেজ
বেড়িবাঁধ এলাকার ১৬/বি হোল্ডিংয়ের ছোটকাটরায় হাজী সেলিমের সরদার কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। এটিও এক ব্যক্তির জমি দখল করে বানানো। জায়গাটি দখলে নেওয়ার পর আজও তা উদ্ধার করতে পারেনি ওই পরিবার। বাধ্য হয়ে আদালতে তারা মামলা করে। কিন্তু সেই মামলার পর বিভিন্ন সময় নোটিস পাঠানো হলেও কোনো তোয়াক্কা করেননি হাজী সেলিম।
আরও যত দখলের অভিযোগ
অভিযোগ রয়েছে, চকবাজারে অবস্থিত মদিনা আশিক টাওয়ারের জায়গাটিও দখল করে তৈরি করা হয়েছে। মদিনা আশিক টাওয়ার দখল করার জন্য মালিকের নামে ভুয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করেন সেলিম। এরপর পুরো জায়গা দখল করে নেন। এ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিলের পাশে নবাব পরিবারের জমি দখল করে সেখানে মার্কেট করার অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে। চকবাজারের মৌলভীবাজারে গুলমদন টাওয়ারের পাশে বিসমিল্লাহ টাওয়ার মার্কেটটিও দখল করে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত রোববার সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে মারধরের ঘটনা ঘটে। এরপর র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে ঘটনার পেছনের ঘটনা। সবশেষ কয়েকটি মামলা হয়। ইতিমধ্যে কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে বরখাস্ত করা হয়েছে।