ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তবুও কমছে না ধর্ষণ-পীড়ন

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:১০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৯, ২০২০

সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ঘোষণা করার পরও থেমে নেই এ অপরাধ। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ হচ্ছে, নথিভুক্ত হচ্ছে মামলা, গ্রেফতারও করা হচ্ছে অভিযুক্তদের। কিন্তু কমিয়ে আনা যাচ্ছে না এই অপরাধের সংখ্যা। মানবাধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, প্রভাবশালীদের চাপ, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, শারীরিক আলামত না পাওয়া এবং সাক্ষীর অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ অপরাধের বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। আর তাই অপরাধীদেরও থামানো যাচ্ছে না।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সে হিসেবে প্রতি মাসে দেশে একশ’র বেশি এবং প্রতিদিন গড়ে তিনটির বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই নয় মাসে ২০৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের এবং ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন।

এছাড়া ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ, যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে আসক।

এদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৫১টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৫৪ হাজার ৬১৮টি মামলা।

দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী ব্যাপক আন্দোলনের মুখে গত ১২ অক্টোবর ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে সংশোধিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ অধ্যাদেশ আকারে জারি করে সরকার। অধ্যাদেশটি জারি ১৬ দিন পেরিয়ে গেলেও থেমে নেই ধর্ষণের ঘটনা।

গতকাল বুধবার ও আগের দিন মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্ষণের সংবাদ পাঠিয়েছেন দৈনিক খোলা কাগজের জেলা প্রতিনিধিরা। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রীকে এক দোকান মালিক ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। ওই ঘটনায় ছাত্রীর মা ধোবাউড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। একইদিন পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় ৯৯৯-এ ফোন করে ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন এক কলেজছাত্রী।

এছাড়া মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে কিশোরী ও হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে গৃহবধূকে ধরে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। খুলনা, বরিশালের আগৈলঝাড়া, ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ীতে শিশু, মাদ্রাসাছাত্রীসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন নারী। বরিশারের মুলাদী উপজেলা ভিডিপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন এক নারী। চট্টগ্রাম শহর থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ভিন্নপথে বাঁশখালীতে নিয়ে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

গত ২৬ অক্টোবর রংপুর ডিবি পুলিশের এক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে পুলিশের এএসআই রায়হান ওরফে রাজু এবং আলেয়া নামের এক নারীকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণের এসব ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে পারলে এ অপরাধ কমে আসত। রাষ্ট্র যতদিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের না হতে পারবে, ততদিন সমাজে এসব নৈরাজ্য বাড়বে।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, শুধু আইন পরিবর্তন করে অপরাধ দমন করা যায় না। যে আইনটি আছে সেটার খুব কার্যকর প্রয়োগ করা দরকার। যতগুলো ধর্ষণের বিচার হয়েছে, সেখানে সাজার হার মাত্র তিন ভাগ। কিন্তু হারটা যদি ৯৭ ভাগ হত তাহলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না।

মানবাধিকার কর্মী ও নারী নেত্রী খুশি কবীর বলেন, ‘দেশে ধর্ষণ ও নারীদের প্রতি সহিংসতা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এসব ঘটনার সঙ্গে সরকারদলীয় বিভিন্ন লোকজন সম্পৃক্ত, যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিচার হয় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ এসব প্রভাবশালীকে গ্রেফতারও করে না বা গ্রেফতার হলেও তারা আবার জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। সে হিসেবে ধর্ষণ বা নারীদের প্রতি সহিংসতার এসব ঘটনায় আমরা সমাজে খুব ভালো বার্তা দিতে পারছি না। এই কারণে এই ধরনের অপরাধও থামানো যাচ্ছে না। আমার মনে হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই এসব অপরাধ কমে আসবে।’

এদিকে পুলিশ বলছে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এসব মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে বিচারের জন্য প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রুখতে এবং তাদের দ্রুত সহায়তা প্রদানের জন্য কুইক রেসপন্স টিমও (কিউআরটি) করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা সরাসরি প্রতিরোধ করার উপায় একটু কঠিন। এজন্য কুইক রেসপন্স টিম গঠন ও হটলাইন চালু করা হয়েছে। নারীরা রাস্তায় বা অন্য কোথাও অনিরাপদ বোধ করলে বা বিপদে পড়লে এই টিমের তাৎক্ষণিক সাহায্য নিতে পারবেন।

 

 
Electronic Paper