ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নেশায় ঝুঁকছে পথশিশুরা

তুষার আহসান
🕐 ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০২০

ফুটওভার ব্রিজে কিংবা ফুটপাতে বিকেল হলেই নামে তাদের ঢল। বয়স বেশি না। হবে দশ-বারো। সারাদিন দেখা যায় কম। টার্গেট করে পোশাক দেখে। পিছু লেগে থাকে দু’ টাকা, দশ টাকার জন্য। মুখের ভাষ্য থাকে ‘খাবার খাইনি’, ‘মায়ের অসুখ’ ইত্যাদি। এদের আরেকটি দল পথের ধারে, পার্কের মধ্যে এমনকি আবর্জনার স্তূপ থেকে প্লাস্টিক, কাচ, লোহা ও বোতল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই খুঁজতে দেখা যায়। এই দলটি বেশি ভারি। একা একা ঘোরে না। সঙ্গে দু-চারজন তো থাকেই। ভিক্ষা থেকে শুরু করে এরা যেমন দলবেঁধে কাজ করে, তেমনি দুষ্টামিও করে দলবেঁধে। কোনো ক্লান্তি যেন নেই। বাড়ি নেই, ঘর নেই, কোথা থেকে এসেছে জানে না অনেকেই। তারপরও তাদের মধ্যে সখ্যতা। এই সখ্যতা অবশ্য একই পেশার কারণে গড়ে উঠেছে তা নয়, একই নেশার কারণে। ছোট ছোট নেশা থেকে এখন তারা বড় বড় নেশাতেও জড়িয়ে গেছে বলে রয়েছে তথ্য। মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকে আবার এদের মধ্য থেকেই বেছে নিয়েছে তাদের সাপ্লাইয়ার হিসেবে। করছে ছিনতাই, চুরি। অথচ কে রাখে কার খবর। প্রশাসনও কোমলমতি এসব শিশুর ক্ষেত্রে নির্বিকার। তবে তারা কি এখন আর কোমলমতি থাকল এমন প্রশ্ন সুধীজনদের।

সরেজমিন দেখা যায়, যে বয়সে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সে বয়সে জীবিকার সন্ধানে বস্তা হাতে নিয়ে ময়লার স্তূপ, পথের ধার, দোকানের আশপাশ থেকে কুঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে ফেলে দেওয়া বস্তু। নোংরা কুঁড়াতে কুঁড়াতে আসক্ত হচ্ছে নেশায়। বিড়ি, সিগারেট, পান তাদের কাছে সাধারণ বিষয়। এগুলো তাদের ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত চলতেই থাকে। ছুটোছুটি বা কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই আড়ালে বসে পলিথিন কিংবা কাগজের মোড়কে মুখ ডুবিয়ে কী যেন করছে তারা। দূর থেকে দেখে মনে হয়, খুনসুঁটিতে ব্যস্ত। অথচ কাছে যেতেই দেখা যায়, নীরব নেশায় ডুবে আছে তারা।

রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ছবির হাট, টিএসসি এলাকা, আজিমপুর কবরস্থান, লালবাগ, ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজ, চন্দ্রিমা উদ্যান, খিলখেত ওভারব্রিজ সংলগ্ন রেললাইন এলাকা ও তার আশপাশের কিশোর বয়সী পথশিশুদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ভয়ঙ্কর তথ্য। যদিও প্রশ্ন করতেই অনেকে আবার দৌড়ে পালিয়ে যায়। কথায় কথায় এফডিসি এলাকার কয়েকজন পথশিশু জানায়, আঠা জাতীয় ড্যান্ডি নেশায় বেশি আসক্ত তারা। ফার্নিচার, জুতা ও টায়ারের দোকানে ব্যবহৃত-অব্যবহৃত বিভিন্ন আঠার কৌটা কিনে সেই আঠার ঘ্রাণ থেকে তৈরি হয় নেশা। টাকা জমিয়ে ঘুমের ওষুধ ও জন্মনিরোধ পিল থেকেও করে নেশা।

সাগর, আক্তারের মতো কয়েকজন জানায়, সারাদিন পরিশ্রম শেষে ক্লান্তি থেকে বাঁচতে বা ময়লা তুলতে হাত পা কেটে যাওয়ার ব্যথা অনুভব থেকে রক্ষা পেতেও নেশা করে থাকে তারা। এক পথশিশু জানায়, প্রথম প্রথম গন্ধটা নিলে শরীর শীতল মনে হতো। এখন কেমন যেন ঝিমঝিম ভাব আসে। অনেক ঘুমও এসে যায়। সাইকেলের গ্যারেজ, পানের দোকান, ফার্নিচার বা মহল্লার জুতার দোকান থেকে ৩০-৩৫ টাকায় কেনা যায় একটি আঠার কৌটা। জানা যায়, তাদের নেশার তালিকায় আরও রয়েছে গাঁজা, সিরিঞ্জও। ওরা নিয়মিতই এসব নেশা করে থাকে। এসব নেশা করার সময় অনেকে মারধরও করে তাদের।

আজিমপুর এতিমখানা সংলগ্ন এক দোকানী বলেন, ওরা সারাদিন কাগজ কুঁড়ায়। চা, পান, বিড়ি ও সিগারেট সব খায়। কী করছে জিজ্ঞেস করলেই নেশা করা অবস্থা ঢুলতে ঢুলতে পালিয়ে যায়। কয়েকবার মারও দিয়েছি। কাজ হয় না। কয়েকজন পথচারী বলেন, সারাদিন এটাওটা কুড়াতে দেখি। আবার এরই ফাঁকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির আবডালে গিয়ে নেশা করতে দেখেছি। এমন নেশা থেকেই একদিন এরা বাসা-বাড়িতে সুযোগ পেলেই চুরি করে। একসময় এই শিশুরা ধীরে ধীরে কিশোর গ্যাং দলের সক্রিয় সদস্য হয়ে যায়।

অবহেলিত পথশিশুদের সম্পর্কে নিজ উদ্যোগে এক সময় কাজ করেছেন জাহিদ সুমন। তিনি বলেন, পথশিশুরা অধিকাংশই জন্মের পর থেকেই পরিবারের ভালোবাসা পায় না। এর ফলে ধীরে ধীরে পরিবারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে তারা। আলোর দেখা পাওয়ার আগেই তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আর তাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। তাই সন্তানদের শুরুতেই সু-শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এনজিওদের এক সময় খুব ভালো কাজ করতে দেখেছি। এখন দেখছি না। আমিও যেমন ছাত্রাবস্থায় অনেক করেছি, এখন সময়ের অভাবে হচ্ছে না। সর্বস্তরের লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে, সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে পরিকল্পনা নিয়ে। তাহলে এরা সমাজের বোঝা না হয়ে দেশের গর্ব হয়ে উঠতে পারে এক সময়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের ফলে কিডনি, লিভার, পাকস্থলি ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। কোষ্ঠকাঠিন্য, খাবারে অরুচিসহ সংক্রামক নানা রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মনরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের শিশুরা, সে পথশিশুই হোক, তাদের দায়িত্ব সরকারের। তারপর জনগণের। সরকারকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে জনগণ এক ধাপ হলেও এগিয়ে আসবে। এক সময় বেসরকারিভাবে অনেকে কাজ করত। এখন করছে না। করছে না, নানা কারণে। এই তো বছর দেড়েক আগের কাহিনী। শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনকে নাস্তানাবুদ করা হলো। কে এগোবে এ কাজে আর? আবার পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার নামে নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গও পাচারের কাহিনিও আমাদের জানা। সুতরাং সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগোলে এসব পথশিশু আমাদের জন্য বোঝা না হয়ে এক সময় দেশের উপকারে লাগবে বলে আমি মনে করি।

 
Electronic Paper