ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বইয়ের মান রক্ষায় কঠোর এনসিটিবি

তোফাজ্জল হোসেন
🕐 ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০২০

বিনামূল্যে পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বই ছাপার আগে তিন স্তর এবং পরে এক স্তরে তদারকি করছে পরিদর্শন এজেন্সি। শুধু তাই নয়, গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে এবার প্রত্যেক প্রেসে ২৪ ঘণ্টার মনিটরিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কাগজের ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ (স্থায়িত্ব), জিএসএম (উজ্জ্বলতা) কম থাকায় এরই মধ্যে এক হাজার টনের বেশি কাগজ ও আর্টপেপার বাতিল হয়েছে। পরিদর্শন এজেন্সির কড়াকড়িতে নড়েচড়ে বসা অনেক মুদ্রণকারী প্রেস থেকে নিম্নমানের কাগজ সরিয়ে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

এনসিটিবির তথ্যমতে, ৬ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরে ৭৬০ টন কাগজ বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে লেটার অ্যান্ড কালার প্রিন্টার্সের ৩০০ টন, মোল্লা প্রিন্টার্সের ১৮০ টন, বর্ণ ও শোভা প্রিন্টার্সের ১২৬ টন রয়েছে। বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো কাগজ পরিদর্শনের আবেদন করলে সেটি আরও বেড়ে যেতে পারে। তবে এজেন্সির কড়াকড়ির বার্তা পাওয়ার পর বড় মুদ্রণকারীরা প্রেস থেকে নিম্নমানের কাগজ সরিয়ে ফেলেছে। এদিকে শিড মেশিনের জন্য এনসিটিবির কেনা ১৩ হাজার মেট্রিক টন কাগজের মধ্যে গত রোরবার মেঘনা পেপার মিলের ৩০০ টন এবং বসুন্ধরার ২০০ টন আর্টপেপার বাতিল করা হয়েছে।

সূত্র মতে, মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ২৫ কোটি বই ছাপার কাজ তদারকি করছে ‘ইনডিপেনডেন্ট ইন্সপেকশন সার্ভিসেস বিডি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথমবারের মতো কাজ করতে এসে অনেকটা চমক দেখিয়ে প্রথম ১৫ দিনে ২০টি প্রেসের প্রায় এক হাজার টন নিম্নমানের কাগজ বাতিল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কাগজ বাতিল করায় কিছু অসৎ মুদ্রণ ব্যবসায়ীর নানা ধরনের হুমকি ধামকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহ নোয়াখালীতে অবস্থিত একটি প্রেসে নিম্নমানের কাগজ বাতিল করায় পরিদর্শন এজেন্সিকে হুমকি দেওয়া হয়। এজেন্সি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে জানানোর পর জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওই প্রেসে নজরদারি বাড়ানো ও পরিদর্শক টিমকে নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশের পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুজিববর্ষে বইয়ের মান যেন কোনো হেরফের না হয়- এমন কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, তদারকি প্রতিষ্ঠানকে বইয়ের মান ইস্যুতে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছি। কোনো ছাড় নয়। তাদের ওপর কোনো চাপ এলে এনসিটিবিকে জানাতে বলেছি। পরিদর্শন টিম এবার বেশ তৎপর। তাই মান রক্ষায় যা দরকার সব ধরনের সহযোগিতা তাদের দেওয়া হবে।
এনসিটিবির তথ্যমতে, বইয়ের মান ঠিক রাখতে চলতি বছর ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ (বইয়ের স্থায়িত্ব) ১৪ থেকে ১৬, জিএসএম ৮৫ শতাংশ (উজ্জ্বলতা), তদারকি পদ্ধতিসহ বেশ কিছু নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। ফলে চলতি বছর নিম্নমানের কোনো কাগজে বই ছাপার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। ‘ইনডিপেনডেন্ট’ ৫২টি প্রেসে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে আলাদা ৫২ জন দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। যাদের কাজ হবে প্রেসে নিম্নামানের কাগজ-আর্টপেপার যাতে না ঢুকাতে পারে সেটা নিশ্চিত করা, ছাপা হওয়ার পর বইয়ের মান চেক করে ডেলিভারির অনুমতি দেওয়া। এরপর উপজেলায় বই পৌছানো, সেখান থেকে স্যাম্পল নিয়ে তা আবার পরীক্ষা করা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে কোনো প্রতিষ্ঠানই প্রেসে সার্বক্ষণিক লোক রাখার কাজটি করেনি। এতে ছাড়পত্র পাওয়া কাগজ বদলে গভীর রাতে নিম্নামানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো হতো। সেটা ঠেকাতে ইনডিপেনডেন্ট এ পদক্ষেপ নিয়েছে।

জানা গেছে, কাগজের ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ (স্থায়িত্ব) ১৪ হওয়ার কারণে বছরের মাঝামাঝি সময় বইয়ের পাতা বেঁকে এবং লাল হয়ে যায়। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৪ থেকে ১৬ করার প্রস্তাব দেন। সেটি আমলে নিয়ে এক দিনের একটি প্রশিক্ষণ করা হয়। সেখানে মুদ্রণ ব্যবসায়ী, শিক্ষা ও প্রাথমিক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ১৬ করা হয়।

মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে কাগজের দাম টন প্রতি ৪৫ হাজার টাকা কমলেও গত মাস থেকে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। পেপার মিলগুলো প্রতি টন কাগজ ৬০ হাজার টাকার কমে দিচ্ছে না। অথচ বাজারে ৪৫-৪৬ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। গত বছর খোলা বাজারে এসব কাগজ ছাড়পত্র পেলেও একই মানের কাগজ এবার গণহারে বাতিল হচ্ছে। এর প্রধান কারণ বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, টনপ্রতি ১০-১২ হাজার বাঁচাতে গিয়ে মুদ্রণরা নিম্নমানের কাগজ কিনছেন। গত বছর নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে ছাড়পত্র নিলেও এবার পরিদর্শন এজেন্সি তা আটকে দিচ্ছে। ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ ১৬, ৮০ শতাংশ জিএসএম (পুরুত্ব) এবং ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এনসিটিবি।

জানা গেছে, চার স্তর তদারকির প্রথম স্তরে কাগজের মান দেখা হয়। পরিদর্শন এজেন্সি প্রেস থেকে কাগজের তিন কপি নমুনা সংগ্রহ করে এক কপি প্রিন্টার্স, এক কপি এনসিটিবি এবং অন্য কপি ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। কাগজের মান ভালো হলে ছাড়পত্র, না হলে তা বাতিল করে প্রেস থেকে সেই কাগজ সরিয়ে ফেলা হয়। কাগজের ছাড়পত্রের বই ছাপা পর্যন্ত প্রতিটি রুল তদারকি করতে একজন ২৪ ঘণ্টা ওই প্রেসে অবস্থান করছে।

ছাপার পর ডেলিভারি পর্যন্ত তা নজরে থাকে। এখানেই শেষ নয়, বই উপজেলায় পৌঁছানোয় সেখানে নমুনা বই সংগ্রহ করা হবে এবং আগের বইয়ের সঙ্গে মান মিলানো হবে। এভাবেই কঠোর তদারকি চলছে এবারের পাঠ্যবইয়ের। এসব স্তরে আগে নানা কারসাজি হতো। পরিদর্শন টিম ও মুদ্রণদের যৌথভাবে নিম্নমানের বই ছাপানো হতো এবং তা সরবরাহ করা হতো।

চলতি বছর প্রাথমিকে ১০ কোটি ২৫ লাখ ৫৩৪ এবং মাধ্যমিক স্তরে ২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার কপি বই ছাপা হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক ৯৮টি লট আর মাধ্যমিকে ২১০, ৭৫ এবং ১৭৫ লটের ভাগ করে কাজ দেওয়া হয়েছে।

 
Electronic Paper