পর্নোগ্রাফির ফাঁদে কিশোরী-তরুণীরা
প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১০:০২ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২১, ২০২০
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছে দেশের কিশোরী ও তরুণীরা। ইতিমধ্যে এমন চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে কমপক্ষে ৪৫ কিশোরীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও। র্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রের বাকিদের ধরে আইনের আওতায় আনতে অভিযান চলছে। এক্ষেত্রে পরিবারসহ সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোরী ও তরুণীদের টার্গেট করে প্রথমে আলাপচারিতার মাধ্যমে সখ্য গড়ে তুলত একটি চক্র। ভার্চুয়াল এই প্রেমের একপর্যায়ে ওই কিশোরী ও তরুণীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হতো নগ্ন ছবি ও ভিডিও। চক্রটি সেসব নগ্ন ছবি ও ভিডিও সরবরাহ করত বিভিন্ন পর্নো গ্রুপ ও ওয়েবসাইটে। এভাবেই সেসব ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে যেত ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে বিশে^র এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
কয়েক বছর আগে ঢাকার এক তরুণের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে পরিচয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে মেয়েটিকে তার নগ্ন ছবি দেওয়ার প্রস্তাব করে ছেলেটি। বিশ^স্ততা অর্জন করায় চাপাচাপির একপর্যায়ে ওই কিশোরী তার ঢাকার বন্ধুটিকে কিছু নগ্ন ছবি দেয়। পরে ওই কিশোরী বুঝতে পারে সে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। এরপরই ফেসবুকে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কাছে অভিযোগ জানায় মার্কিন কিশোরী।
চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ পাওয়ার পরই চক্রটিকে শনাক্ত করতে কাজ শুরু করে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। দীর্ঘ আট মাস অনুসন্ধানের পর গত ১৫ অক্টোবর ঢাকার বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক এ চাইল্ড পর্নোগ্রাফি চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলোÑবোরহান উদ্দিন (২৬), মো. আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ (২৫) ও মো. অভি হোসেন (২৫)। তারা বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত রোববার গ্রেফতার তিনজনই তাদের অপরাধ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতার বোরহানের ব্যবহৃত কম্পিউটার থেকে প্রায় তিন হাজার ৩০০টি ফাইলে অভিযোগকারী মার্কিন কিশোরীসহ ৪৫ জন দেশি-বিদেশি কিশোরীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে। তার কম্পিউটারটি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে লগইন অবস্থায় পাওয়া গেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে বোরহান পুলিশকে জানিয়েছে, সে ইনস্টাগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। কিশোরীদের সঙ্গে পরিচয়ের পর সখ্য গড়ে তুলে কৌশলে তাদের কাছ থেকে নগ্ন ছবি-ভিডিও কনটেন্ট সংগ্রহ করে সেগুলো চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপগুলোতে আপলোড করত।
সিটিটিসির সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, চক্রটি নিজেদের পরিচয় গোপন করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উঠতি শিশু-কিশোরীর সঙ্গে পরিচিত হয়। এরপর কৌশলে তাদের নগ্ন ছবি-ভিডিও সংগ্রহ করে তা পর্নোগ্রুপ ও ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। ডার্ক ওয়েবসাইটেও তাদের রেজিস্টার্ড মেম্বারশিপ আছে বিভিন্ন ধরনের পর্নো ওয়েবসাইটে। যেখানে তারা এ ধরনের পর্নোগ্রাফি কনটেন্টগুলো শেয়ার করত।
তিনি আরও বলেন, চক্রটির অন্য সদস্যদের ধরতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি চক্রটি চাইল্ড পর্নো ট্রেড করে অর্থনৈতিকভাবে কী ধরনের সুবিধা পেয়েছে, সেগুলোও আমরা খতিয়ে দেখছি। সাইবার জগতের ডার্কওয়েবে পাতা এমন ফাঁদ থেকে কিশোর-কিশোরীদের রক্ষা করতে পরিবারকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সবাইকে সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারও সঙ্গেই যেন কোনো ধরনের ব্যক্তিগত বা অশ্লীল কনটেন্ট শেয়ার করা না হয়।
এ ছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন থাকা উচিত। ধরুন, আপনি আপনার মোবাইল ফোনটি ঠিক করার জন্য কোনো মেকারের কাছে দিয়েছেন। এমন হতে পারে সেই মেকারই আপনার ফোনের ডিলিটেড পার্সোনাল কন্টেন্টগুলো প্রিজার্ভ করে সেটি দিয়ে আপনাকে ব্ল্যাক মেইল করছে অথবা সেগুলোর অপব্যবহার করছে। শুধু এই চক্রটিই নয়, সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে সে ঘটনার এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ওই ঘটনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সংশোধিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ অধ্যাদেশ আকারে জারি করে সরকার। এরপরও থেমে নেই এ ধরনের ঘটনা।
গত শনিবার টাঙ্গাইলের সখীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর গোসলের ভিডিও গোপনে ধারণের পর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে দুই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া সম্প্রতি যশোরের মণিরামপুর উপজেলায় এক গৃহবধূর গোপন ভিডিও ধারণের অভিযোগে থানায় মামলা হলে ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ৮ এর ১ ধারা অনুযায়ী কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে কোনো প্রলোভনে অংশগ্রহণ করিয়ে তার জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থিরচিত্র, ভিডিওচিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং এ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- এবং দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের অপরাধ ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ষণের চেয়েও বড়।
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ধর্ষণের পর হত্যা যেমন ভয়ঙ্কর অপরাধ, আমার মতে কারও ব্যক্তিগত ভিডিও অথবা ধর্ষণের পর সে দৃশ্য ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াও মারাত্মক অপরাধ।
এসব বিষয়ে সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, মোট ২৬ হাজারের বেশি পর্নোসাইট আমরা বন্ধ করেছি। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সাইট বন্ধ করা হচ্ছে এবং এটা করতেই থাকব। কিন্তু বিষয় যেটা দাঁড়িয়েছে, এ জায়গাটার ক্ষেত্রে শুধু আইন যথেষ্ট নয়।
আইন নিঃসন্দেহে অপরাধ দমন করার একটি হাতিয়ার। কিন্তু তার চেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা, শিক্ষার প্রভাব বিস্তার করা। এ সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের চর্চা করতে হবে।