ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনার মধ্যে ডেঙ্গু

তুষার আহসান
🕐 ১১:১১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০

করোনার মধ্যে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। মার্চ থেকে করোনাকালীন সাত মাসে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৬ জন। চলতি বছরে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় অর্ধসহস্র। গতকালও একজন শনাক্ত হয়েছে। বেশ কয়েকজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা ও ডেঙ্গুর লক্ষণ জ্বর হওয়ায় অনেকে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাচ্ছেন না বলে মন্তব্য তাদের। এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে রাজধানীবাসী ও দুই সিটি করপোরেশনের রয়েছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। সংশ্লিষ্টদের অবহেলাকে দায়ী করছেন নগরবাসী আর ‘জরিমানার পরও বাড়ছে না সচেতনতা’ বলছেন সিটি কর্মকর্তারা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, তারা মশা নিধনে সফল হয়েছে। অন্যদিকে মাসখানেক আগেও টেন্ডার জটিলতায় উড়ন্ত মশা মারার ওষুধ সংকটে পড়ে ডিএসসিসি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বলছে, ডিএসসিসির ১৬টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ের মাঝামাঝিতেও নগরজুড়ে ৪৫ শতাংশ বাড়িতেই পাওয়া গিয়েছে এডিসের লার্ভা।

গত বছর দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ভয়াবহ সে পরিস্থিতি সামাল দিতে দুই সিটি করপোরেশনকেই হিমশিম খেতে হয়। ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে নানা প্রকল্প, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়। এ জন্য কলকাতা ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাও নিয়ে আসে রাজধানীর দুই সিটি। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলাদা বিভাগ চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও তার সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি পরিসংখ্যান মতে, গত বছর মশাবাহিত এই রোগে মারা যায় ১৭৯ জন। এ বছরও থেমে নেই ডেঙ্গুর বিস্তার।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমসূত্রে জানা যায়, সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় একজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৫০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন এবং জুনে ২০ জন এবং জুলাইয়ে ২৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর আগস্ট থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন আরও ১১২ জন। ফলে করোনাকালীনই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৬ জন। একটি মৃত্যুর তথ্য থাকলেও তা ডেঙ্গুজনিত নয় বলে নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।

মশা নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, দুই ধরনের পরিকল্পনা দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে তারা। প্রথমত বছরব্যাপী, দ্বিতীয়ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিদিন সকাল-বিকাল ৪ ঘণ্টা করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা চিরুনি অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ, যান, যন্ত্রপাতি ও কর্মীবাহিনীও।

ডিএনসিসি সূত্র জানিয়েছে, মে মাসে ৯ হাজার ৪৬৩টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। ৫ থেকে ১৫ জুন ৫৪টি ওয়ার্ডে ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৩৫টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১ দশমিক ১৯ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে।

চিরুনি অভিযানে প্রায় ৬৭ শতাংশ স্থাপনায় এডিসের বংশ বিস্তারের উপযোগী পরিবেশ দেখা গেছে। আর জুলাই মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৭৭টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যায়।

গণমাধ্যমকে দেওয়া দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের এক বক্তব্য থেকে জানা যায়, ডিএসসিসিতে আগে সকালে এক ঘণ্টা লার্ভিসাইডিং ও বিকালে এক ঘণ্টা অ্যাডাল্টিসাইডিং করা হতো। সেটাকে ৪ ঘণ্টা করা হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে এখন মশার উপদ্রব অনেক কমেছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে গত মে মাসে কাউন্সিলরদের নির্দেশনা দেন ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক কাউন্সিলর তার ওয়ার্ডের মশক নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী থাকবেন এবং তাকেই জবাবদিহি করতে হবে।’ অথচ মশা নিধন মানে ধোঁয়া ছাড়া কিছু নয় বলে দাবি নগরবাসীর।

ডিএসসিসির অধীন বাড্ডা নূরেরচালা এলাকার মুনির হোসেন বলেন, ‘মশা নিধন মানে তো ধোঁয়া ছেড়ে চলে যাওয়া। তা কয়েকবার করতে দেখেছি। কিন্তু মশা মরার ওষুধ দিয়ে কী হবে? সামান্য বৃষ্টি হলেই এলাকা পানিতে ডুবে যায়। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। রোগ তো বাড়বেই।’

মালিবাগ এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, হুটহাট কয়েকজন আসেন। কখনো কখনো মেয়র সাহেবও থাকেন। অভিযান চলে। জরিমানা হয়। তারা চলে গেলে যা তাই।’ ধানমন্ডিতে নির্মাণাধীন একটি বাড়ির কেয়ারটেকার নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘আসে, জরিমানা দিই। শেষ।’

মশার উপদ্রব প্রসঙ্গে ডিএসসিসির আজিমপুরের গৃহিণী মমতা নূর বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই এলাকা হঠাৎ হঠাৎ ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে যায়। বিদঘুটে গন্ধ। পড়ে শুনি মশা তাড়াতে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেদিন মশার ওই ওষুধ দিয়ে যায়, সে রাতেই মশার উপদ্রব বেশি বাড়ে।’

একই এলাকার এক মুদি দোকানি জানান, এক-দুজন আসে, যেখানে সেখানে ওষুধ দিয়ে চলে যায়। গত এক মাসে আমাদের এপাড়ায় আর দেখি না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা বসে নেই। গত মে ও জুন মাস মশা নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেছি। প্রতি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগে ভাগ করে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি ভাগে ৫ জনের একটি দল স্থাপনা পরিদর্শন করছে।’

আগস্ট-সেপ্টেম্বরকে ডেঙ্গুর পিক টাইম উল্লেখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে এসে এর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। আসলে এটাতে সন্তুষ্ট থাকার কোনো কারণ নেই। গত ৮ মার্চ যখন দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ঠিক তখন থেকে আইইডিসিআরের তথ্যে ডেঙ্গু রোগী কমতে থাকে। এর অন্যতম কারণ হয়তো ডেঙ্গুর লক্ষণ জ্বর, করোনার লক্ষণও জ্বর। মানুষের জ্বর হলে তখন তারা তেমন একটা ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতো না।’

এদিকে ডেঙ্গুরোধে জনসচেতনতাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছেন পরিবেশবিদরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মাইকিং, লিফলেট, স্টিকার বিতরণ, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে মশকনিধনসহ নানা কাজ বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

 

 
Electronic Paper