ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা
দায়ীদের খুঁজছে ইসি
কারা হচ্ছেন মা-বাবা, নজরদারিতে কর্মকর্তাও, কারিগরি ও প্রশাসনিক কমিটি গঠন, সরেজমিন পরিদর্শন
মো. হুমায়ূন কবীর
🕐 ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০
ভোটার তালিকায় বারবার রোহিঙ্গাদের যুক্ত পাওয়া যাচ্ছে। ভোটার হওয়ার পর এদের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও (এনআইডি) পড়ছে। সর্বশেষ চলতি বছর ভোটার তালিকায় থাকা এসব রোহিঙ্গার নাম বাদ দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দেন এক উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। এদিকে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে এককভাবে দায় নিতে নারাজ ইসি। এ জন্য কমিশন ছাড়া আর কারা দায়ী-সে বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে কমিশন। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী অফিসার সাদিয়া আফরিন কচি এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর পাঠান। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালের হালনাগাদ ভোটার তালিকায় মিয়ানমারের ১৩ রোহিঙ্গা নাগরিক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন।
যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অভিযোগের বিষয়ে যাচাই করা হয়। এ বিষয়ে চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোটার তালিকা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অভিযুক্তদের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ের পর সর্বসম্মতভাবে অভিযুক্তরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক বলে সিদ্ধান্ত হয় এবং তাদের সবার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাতিল করার সুপারিশ করা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
ইসি সূত্র জানায়, ইউএনওর এ চিঠি পাওয়ার পর বান্দরবান পার্বত্য জেলার জেলা নির্বাচন অফিসারের কাছে এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গত ১৩ আগস্ট সরজমিন প্রতিবেদন ইসিতে পাঠান। তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সন্তোষজনক প্রতিবেদন দিতে পারেননি। পরে এ বিষয়ে গঠন করা হয় বিশেষ কমিটি।
রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ঠেকানো নির্বাচন কমিশনের একার কাজ নয় উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম খোলা কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উপজেলাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় নতুন ভোটার নিবন্ধন করার জন্য একটি বিশেষ ফরম তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ভোটার হতে গেলে তাদের মা-বাবার এনআইডির কপি, নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধন সনদসহ বেশ কিছু ডকুমেন্টস দিতে হচ্ছে। আর এগুলো কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে সরবরাহ করা হয় না।
এখন যেসব রোহিঙ্গা ভোটার হচ্ছেন-কে তাদের বাবা হচ্ছেন, কে তাদের নগরিকত্ব সনদ দিচ্ছেন, কে জন্ম সনদ দিচ্ছেন? তাদের চিহ্নিত করে এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। এনআইডি নিতে যেসব দলিল লাগে, সেগুলো কীভাবে রোহিঙ্গারা পায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এটি নিয়ে বিশেষ কমিটি কাজ করছে। সমন্বয়ের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। ইসির কর্মকর্তাদেরও নজরদারি করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক তথ্যসহ আলাদা রোহিঙ্গা ডাটাবেজ স্থাপন করা হয়েছে। অবৈধভাবে রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি অনুসন্ধানে একটি টিম পাঠানো হয়।
পরবর্তীতে অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তের জন্য ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কারিগরি কমিটি এবং একটি প্রশাসনিক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের প্রতিনিধি রয়েছেন। অধিকতর তদন্তের সুবিধার্থে নির্বাচন কমিশনের একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটি গঠন করা হয়। উভয় কমিটিতে বহিঃসংস্থার সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তিরোধে এবং ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়া, জাতীয় পরিচয়পত্র মুদ্রণ ও বিতরণসহ সার্বিক বিষয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিতকরণ এবং দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ইসি যুগ্ম-সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. কামাল উদ্দিন বিশ্বাস কমিটির অন্য সদস্যদের নিয়ে তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম যান।
সেখান থেকে ফিরে আসার পর এ বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বলার মতো অগ্রগতি এখনো হয়নি। আমরা পরিদর্শন করে এসেছি। আমাদের আরও কিছু তথ্য দরকার যা এনআইডি উইংয়ে চেয়েছি। এতে আরও সময় লাগবে।
ইসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এসব এলাকায় কড়া নজর রাখছে কমিশন। তারপরও এদের ভোটার তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা ঠেকানো যাচ্ছিল না। গত বছর রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডিÑবিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে মাঠপর্যায়ে আরও কড়া নির্দেশনা দেয় ইসি। তখন রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৩২ উপজেলাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে সব উপজেলা-থানা নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, বিশেষ এলাকায় কেউ যাতে বিশেষ কমিটির সুপারিশ ছাড়া ভোটার হতে না পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে কার্যালয়ে আসা ব্যক্তির বাংলাদেশি নাগরিকত্ব। সব সরঞ্জাম নিজের কাছে রাখতে হবে। সার্ভারে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরকে দিয়ে তথ্য আপলোড করানো যাবে না। আর এসব বিষয় তদারকি করতে হবে জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে।
এ ছাড়া রোহিঙ্গারা যাতে কোনোভাবেই ভোটার হতে না পারে, সে বিষয়ে ১০ দফা নির্দেশনাসহ কঠোর নজরদারি রাখতে মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহকারীদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সে সময় জানান ইসি সচিব। তিনি বলেছিলেন, এসব বিশেষ এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি রয়েছে।
তখন দেওয়া ইসির নির্দেশনায় বলা হয়, বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত সব জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অলাইনে যাচাই করতে হবে। যাচাইকালে (ক) ভাইবোনের ডাটাবেজে পিতা/মাতার নামের সঙ্গে আবেদনকারীর ফরম-১ এ উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের মিল থাকতে হবে। (খ) চাচা/ফুফুর ডাটাবেজে তাদের পিতার নাম ও ঠিকানার সঙ্গে আবেদনকারীর বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত পিতামহের নাম ও ঠিকানার মিল থাকতে হবে। (গ) প্রয়োজনে নিকট আত্মীয়ের মোবাইল নম্বরে কথা বলে তাদের পরিচিতি/তথ্য সম্পর্কিত বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
এ ছাড়া উপজেলা বিশেষ কমিটি প্রতিটি ফরম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাইপূর্বক সিদ্ধান্ত দেবে। রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে যদি কেউ তাদের সপক্ষে সহযোগিতা অথবা মিথ্যা তথ্য দেন বা মিথ্যা/জাল কাগজপত্র সরবরাহ করেন অথবা সংশ্লিষ্ট কারও গাফিলতি ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে বলেও জানানো হয়।
সর্বশেষ ভোটার তালিকা হালনাগাদ অনুযায়ী ইসির তালিকায় বর্তমানে মোট ১০ কোটি ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ১১২ জন ভোটার রয়েছেন।