ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আড়ালে বেপরোয়া ড্রাইভার মালেক

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

শুধু বদলি-পদোন্নতি ও নিয়োগবাণিজ্য অথবা জাল টাকার ব্যবসা নয়, রাজধানীর তুরাগ এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিনিময়েও প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের আলোচিত গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে বাদল। রয়েছে নিজ মালিকানায় হোটেল, ডেইরি ফার্ম, গাড়ি-বাড়িসহ অঢেল সম্পদ। সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়ার বামনার টেক এলাকায় রমজান মার্কেটের পাশে ছয়কাঠা জায়গার ওপর সাততলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক ভবন রয়েছে ড্রাইভার মালেকের। এছাড়াও একই এলাকায় রয়েছে আরও দুটি প্লট। এর মধ্যে একটি ১৫ কাঠার, যেখানে ছেলের নামে ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে মালেকের, যাতে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভী রয়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার মানুষ মালেককে ‘হাজী বাদল’ নামেই চেনেন। মালেক গ্রেফতার হওয়ার পর তার অনিয়ম ও দুর্নীতির খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এখানকার মানুষ। তারা জানতেনই না এই ব্যক্তি পেশায় একজন গাড়িচালক।

স্থানীয়রা আরও জানান, বামনার টেক এলাকায় আলিশান দুটি বাড়ি ও অঢেল সম্পত্তি থাকার কারণে আবদুল মালেককে সবাই বেশ সম্মান করেই চলতেন। সবাই জানতেন, তিনি সরকারি বড় পদের কর্মকর্তা। বিভিন্ন দফতরের প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। যে কারণে তুরাগ এলাকার নতুন বাড়িওয়ালারা গ্যাস সংযোগ নেওয়ার জন্য মালেকের কাছে যান।

মালেক তাদের জানান, তিনি গ্যাস সংযোগ নিয়ে দিতে পারবেন, সে বাবদ স্থানীয় বাড়িওয়ালাদের কাছে তিনি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দাবি করেন।

তারা আরও জানান, এলাকার কমপক্ষে ১০০ বাড়িতে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ পাইয়ে দিয়েছেন আবদুল মালেক। সে হিসাবে প্রতিটি বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নিয়ে থাকলে অবৈধ গ্যাস সংযোগ পাইয়ে দেওয়া বাবদ তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন অর্ধকোটি টাকা।

সুমাইয়া বেগম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, উনি (মালেক) গ্যাস সংযোগ পাইয়ে দেবেন বলে জানানোর পর অনেকেই তার কাছে তদবির শুরু করেন। তখন তিনি কারও কাছ থেকে ৫০ হাজার, কারও কাছে ৬০ হাজার, যার কাছ থেকে যা পেরেছেন নিয়েছেন। এভাবে তিনি এখানকার কম হলেও ১০০ বাড়িতে গ্যাস সংযোগ নিয়ে দিয়েছেন।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আবদুল মালেকের মেয়ে নাজনীন সুলতানা। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমার বাবা চাকরি করে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেতেন। আমাদের এত টাকা নেই, বলা হচ্ছে আমরা নাকি শত কোটি টাকার মালিক। অথচ আমরা এত টাকা জীবনেও দেখিনি। দক্ষিণ কামারপাড়ায় এই একটি বাড়ি আমার বাবার। বলা হচ্ছে এ দুটি বাড়িই আমাদের। কিন্তু এটাও সত্যি নয়। পাশের বাড়িটি মো. জিন্নাত নামে আরেকজনের। এ বাড়ি ছাড়া আমাদের হাতিরপুলে যে নির্মাণাধীন ভবন রয়েছে, সেটি আমার দাদার ছিল।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মহাখালীর আমতলীতে ‘হোটেল কাপাসিয়া’ নামে একটি খাবার হোটেলও পরিচালনা করে আসছিলেন আবদুল মালেক। সম্প্রতি হোটেলটি ৩০ লাখ টাকায় বিক্রির কথাবার্তা চলছিল। তবে এর মধ্যেই র‌্যাব মালেককে গ্রেফতার করায় সেটি আর হয়ে ওঠেনি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহাখালীর ‘হোটেল কাপাসিয়া’র ওই ভবনটি সেলিম রেজা নামে এক ব্যক্তির। তিনিও পেশায় গাড়িচালক। শ্বশুরবাড়ি থেকে তিনি বাড়িটি পান। এরপর ২০০৮ সালে আবদুল মালেক ১৪ লাখ টাকা দিয়ে সেলিম রেজার কাছ থেকে হোটেলের জায়গাটি কিনে নিয়েছিলেন।

স্থানীয়রা আরও জানান, মালেক হোটেলটি কেনার পর এর দেখাশোনা করতেন তার মেয়ের স্বামী রতন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনও চালাতেন তিনি। পরবর্তীতে হোটেলটি আরেকজনের কাছে ভাড়া দেন মালেক। চলতি মাসেই হোটেলটি জমির মালিক সেলিম রেজার কাছে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রির বিষয়ে কথাবার্তা চলছিল। তার আগেই গ্রেফতার হন মালেক।

হোটেলের দায়িত্বে থাকা বুলবুল জানান, আমি এ হোটেলটি আবদুল মালেকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলাম। আগে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ টাকা করে মাসে ৪৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতাম। কিন্তু এখন মাসে ৩৬ হাজার টাকা ভাড়া দিচ্ছি। বিল্ডিংটির মালিক সেলিম রেজা, তবে হোটেলটি তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন আবদুল মালেক।

পেশায় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের গাড়িচালক হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আবদুল মালেক। সেই দাপট দেখিয়ে চিকিৎসকদের বদলি-পদোন্নতি ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ বাণিজ্য করে আসছিলেন অষ্টম শ্রেণি পাস এই ড্রাইভার।

যদিও গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছেন- স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের কোনো পরিবহন পুল নেই, ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগের দায় তার ব্যক্তিগত।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য? শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধীনে গত বছরের ২৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর গঠিত হয়। বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন সে বছরের ৩১ ডিসেম্বর মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।

গাড়িচালক আব্দুল মালেককে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরে ন্যস্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আজ পর্যন্ত নবগঠিত স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর থেকে কোনো প্রকার কেনাকাটা, কর্মচারী নিয়োগ, পদায়ন বা পদোন্নতির কাজ করা হয়নি। কাজেই গাড়িচালক মো. আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর বা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

 
Electronic Paper