ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মানবপাচারের ‘মূল হোতা’ গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৪:৫৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৮

সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার চক্রের মূল হোতা মোহাম্মদ আছেমকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে সিআইডির অর্গানাইজড টিম তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারের পর সিআইডি বলছে, আছেমের বাবা এবং ভাই মালয়েশিয়ায় থাকতেন।
সাধারণ মানুষের কাছে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে সাগরপথে মানুষ পাচার করেছেন আছেম, যাঁদের বেশিরভাগই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
সোমবার সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, আছেম নিজের নামের অ্যাকাউন্টসহ তাঁর বাবা-মায়ের নামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে প্রায় ২৫ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে দেশের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে মানবপাচার চালিয়ে আসছিলেন আছেম। আর বিদেশে পাঠিয়ে সাধারণ মানুষকে আটকে রেখে পরবর্তী সময়ে তাঁদের পরিবারের কাছে মুক্তিপণের মাধ্যমে টাকা আদায় করতেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারীরা কক্সবাজার সাগর চ্যানেল দিয়ে গত কয়েক বছর হাজার হাজার মানুষকে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচার করেছে এবং পাচারের সময় সাগরপথে মৃত্যুবরণ করেছে শত শত বাংলাদেশি নাগরিক। এখনো নিখোঁজ আছে অনেক মানুষ, যাঁদের খোঁজ মেলেনি আজও।
সিআইডি জানায়, এ রকম নৃশংস অপরাধ করেছে কটি সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র। যারা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় সাগরপথে অবৈধভাবে মানবপাচার করে মুক্তিপণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছে। এই সংঘবব্ধ চক্রের সদস্যরা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে এই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র সাগরপথে সিরাজগঞ্জের মাসুদকে মালয়েশিয়ায় পাচার করে। এরপর পাচারকারীরা ফোনে করে মুক্তিপণ হিসেবে তিন লাখ ১০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে মাসুদের বাবা আবদুস সালাম ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ঢাকার মহাখালী শাখার অ্যাকাউন্টে মুক্তিপণের তিন লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠান। কিন্তু এরপরও তাঁর ছেলে মুক্তি না পেলে এই ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে উল্লাপাড়া থানায় একটি মামলা করেন। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম এই মামলা তদন্ত করে জানতে পারে যে, একটি সংঘবব্ধ আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী গ্রুপ মাসুদকে পাচারের সঙ্গে জড়িত। মানি ফ্লো এবং লিংক চার্ট থেকে দেখা যায়, কারা মানবপাচারের অবৈধ অর্থ গ্রহণ করেছে এবং নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। এই মামলা তদন্তকালে ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখার অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে উদ্ঘাটিত হয় একটি সংঘবব্ধ আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র। কীভাবে শত শত মানুষকে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচার করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সিআইবি আরো জানায়, এরই ধারাবাহিকতায় সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. আবদুর রাজ্জাক খান বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে এই মানি লন্ডারিং মামলা তদন্ত করার সময় জানা যায়, এই চক্রের সদস্যদের পরিচয় এবং তারা কীভাবে কোন কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মুক্তিপণের অবৈধ অর্থ নিয়েছে। এই আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের বাংলাদেশের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী ও মূল হোতা মোহাম্মদ আছেমকে গতকাল শনিবার ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম। আছেমের বাবা আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন এবং বড় ভাই মোহাম্মদ খোবায়েদ দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়া আছেন। তাঁর বাবা ও ভাই দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া থাকার সুবাদে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী গ্রুপের সঙ্গে তাঁদের সক্ষতা গড়ে ওঠে। আছেম ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে মানবপাচার কাজে যোগ দেন। আছেম ও তাঁর ছোট ভাই জাভেদ মোস্তফা মানবপাচার করার জন্য প্রথমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাতে দালাল নিয়োগ করেন এবং সারা দেশে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। মালয়েশিয়ায় ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে প্রথমে লোকজন সংগ্রহ করেন। এরপর দালালদের মাধ্যমে সংগৃহীত লোকজনকে তাঁর সহযোগীদের সাহায্যে টেকনাফ থেকে ট্রলারযোগে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডে নিয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকিয়ে রাখেন। সেখানে পাচারের শিকার লোকদের আটক রেখে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশে থাকা তাঁদের বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফোন করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এরপর পাচার হওয়া লোকজনের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের দাবি করা মুক্তিপণের টাকা আছেম ও তাঁর সহযোগীদের কাছে নগদ টাকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দেন। যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হয়, তাদের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মেরে ফেলা হয়। মুক্তিপণের টাকা প্রদানকারীদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের কাছে আবার টাকা দাবি করে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আদায় করা হতো। প্রথমে মুক্তিপণের টাকাগুলো নগদে গ্রহণ করে ও পরে টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ায় এবং ভিকটিমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হওয়ায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে। আছেম তার নিজ নামে, ছোট ভাই জাভেদ মোস্তফা, মা খদিজার নামে এবং তার সহযোগী আরিফ, একরাম, ওসমান সারোয়ারের নামে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে মানবপাচারের অবৈধ অর্থ গ্রহণ করেছে। পরবর্তী সময়ে এই মানবপাচার ব্যবসা আরো প্রসার হলে মুক্তিপণের টাকা নেওয়ার জন্য আছেম এসিএম করপোরেশন (ACM Corporation) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে আরিফুজ্জামান আকন্দ ওরফে আরিফকে নিয়োগ দেন। এরপর আরিফের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ইসলামী ব্যাংক মহাখালী শাখার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে মুক্তিপণের বিপুল পরিমাণ টাকা এই অ্যাকাউন্টে নিয়েছেন।

 
Electronic Paper