অনলাইন পশুর হাট নিয়ে চিন্তায় প্রান্তিক খামারি
রবিউল ইসলাম
🕐 ৯:১০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১১, ২০২০
দেশে কোরবানির ঈদ মানেই উৎসব-আমেজ। অনেকটা দলবেঁধে হাটে গিয়ে কোরবানির পশু কেনাবেচা চলে। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনাভাইরাসের কারণে বদলে গেছে স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। এবার অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচায় বেশি উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সীমিত আকারে কিছু প্রতিষ্ঠান আগে থেকে অনলাইনে পশু কেনাবেচা করে আসছে। গতকাল রাজধানীর ডিএনসিসি এলাকায়ও ডিজিটাল হাট উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু দেশের প্রান্তিক কৃষক ও ছোট খামারির বড় একটি অংশ অনলাইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তারা বলছেন, আমরা তো অনলাইন পদ্ধতি বুঝি না। সেখানে কীভাবে কী করতে হয়, তা আমাদের কে শেখাবে? অনেক কষ্ট করে পশু পালন করে ঈদের হাটের অপেক্ষায় থাকি। তাহলে এবার আমাদের অবস্থা কী হবে?
ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, কোরবানির ঈদে আমরা পশু হাটে নিয়ে যাই। প্রয়োজনে আমরা কয়েক হাট ঘুরিয়ে বিক্রি করি। এবার হাটঘাট নেই। কীভাবে কী করব? খবরে শুনছি, সরকার অনলাইনে পশু বেচাকেনা করবে। অনলাইন সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তারা বলছেন, কিছুটা বুঝলেও শেষদিকে আমরা এগোতে পারিনি। এখন কতটুকু কী করতে পারব জানি না? তবে তারা দাবি করেন, সঠিক ব্যবস্থা করে দিলে আমরা উপকৃত হবো। তবে খামারিরা যেন সহজে তাদের পশু বিক্রি করতে পারেন সেজন্যও নেওয়া হচ্ছে নানা ব্যবস্থা।
করোনা প্রতিরোধে এবার সরাসরি হাট বসানোর বিপক্ষে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে মাঠে কোরবানির পশুর হাট বসিয়ে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মানানো অসম্ভব। খোলা মাঠে গরুর হাট বসানো হলে আরও বড় সর্বনাশ হতে পারে। করোনা আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ নিয়ে যারা হাটে যাবেন, তারা করোনার জন্য সবার জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবেন। অন্যদিকে গরু-ছাগল নিয়ে করোনা সংক্রমণের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কয়েকদিন হাটে অবস্থান করা, বিক্রির টাকার নিরাপত্তাসহ নানা রয়েছে নানা সমস্যা।
এদিকে সচেতন মানুষ ভিড় এড়িয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন। ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিত্যপণ্য কেনাকাটা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবকিছুতেই ব্যবহার করছে অনলাইন প্লাটফর্ম। সে প্রেক্ষাপটে এবার কোরবানির পশুও কেনাবেচা করবেন অনলাইনে। বিভিন্ন খামারির ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে ই-হাট, কোরবানির গরুর মেলা। আবার ই-কমার্স সাইটগুলো তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডিজিটাল হাট করার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে কোরবানি এবং কোরাবানির পশু বিক্রি বাদ দেওয়া যাবে না। কিন্তু হাট বসিয়ে পশু বিক্রির ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এখন সম্ভব নয়। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিকল্পনা করে করোনায় অর্থনীতি সচল রাখা যেতে পারে। কিন্তু এভাবে হাট বাজার খুলে দিলে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিও বাঁচবে না, মানুষও বাঁচবে না। অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, এখনো সময় আছে। পরিকল্পনা করে কোরবানির পশুর অনলাইন বাজার শক্তিশালি করতে হবে। কৃষক এবং ব্যাপারিদের কাছ থেকে গরু সংগ্রহের চেইন গড়ে তুলতে হবে। যেভাবে এবার শাক-সবজি, খাদ্য শস্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকেই নিজের খামারের নামে ফেসবুকে পেজ খুলে সেখানে পশুর ছবি, ভিডিও, বিবরণ, দামসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্যই তুলে ধরেছেন। থাকছে ফ্রি হোম ডেলিভারি। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো খামারি ও অনলাইন প্লাটফর্ম পশু কোরবানি ও মাংস প্রক্রিয়াত করে ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দেওয়ারও অফার দিচ্ছেন।
বিক্রয় ডটকম গরু-ছাগলের অনলাইন হাট বসিয়েছে, এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যেমন ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা এভাবে ওই এলাকার খামারের গরু-ছাগলের ছবি, তার বিবরণ, মূল্য সবই তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্রেতারা চাইলে এসব পশুর মধ্য থেকে পছন্দ করে অর্ডার করলেই তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে সেই পশু। এছাড়া খামারি বা কৃষকদের আহ্বান জানানো হচ্ছে হাটে না হেঁটে গরু বেচুন নেটে।
‘আজকের ডিল ডটকমে’র প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, আমরা ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করি। কৃষক বা খামারিরা তাদের গরু-ছাগলের ছবি আমাদের ওয়েব সাইটে আপলোড করে তার বর্ণনা এবং মূল্য তুলে ধরি। ক্রেতারা পশু পছন্দ করে বিক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এজন্য কোনো ফি নেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আমাদের কোনো ফি দিতে হয় না, এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।
কোরবানির ঈদে ৫ হাজারেরও বেশি গরু নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে ‘কাউহাট ডট কম’। এখানে গরুর ছবি এবং ভিডিওর পাশাপাশি তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে প্রতিটি গরুর বয়স, ওজন ও দাম। ক্রেতারা পছন্দমতো দেখে গরু কিনতে পারবেন এখান থেকেই। এ বিষয়ে কাউহাটের উদ্যোক্তা মো. জুয়েল রানা বলেন, আমরা নিজেদের কসাই দিয়ে সম্পূর্ণ হালাল এবং নিরাপদ উপায়ে জবাই করে মাংস প্যাকেজিং করে গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে দেব।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমাদের ৫ হাজার ৬৬৫টি ডিজিটাল সেন্টারের ১১ হাজার ট্রেইনার রয়েছেন। যারা প্রান্তিক এবং ইউনিয়ন পর্যন্ত উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেন। তাদের আমরা পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দেব, কীভাবে তারা তাদের এলাকায় বিষয়টি নিয়ে কাজ করবেন।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ই-ক্যাবের সদস্যভুক্ত একশরও বেশি অনালাইন প্লাটফর্ম কোরবানির পশু বিক্রি করছে। আমরা তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলেছি, ডিজিটাল হাটের মাধ্যমে এবার কেনাবেচা চলবে। এছাড়া কোরবানির পশু জবাই যেন যত্রতত্র না হয় তার ব্যবস্থা করতেও চেষ্টা চলছে।