শূন্য থেকে শীর্ষে
ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০২, ২০২০
১৯৭৪ সালের কথা। তখন আমার হাতে নগদ টাকা ছিল না। কিন্তু চা কিনতে হলে টাকা লাগবে। নেদারল্যান্ডসের রটারডামভিত্তিক ভ্যান রিস তখন বিশ্বে চা সরবরাহকারীদের মধ্যে সেরা কোম্পানি। নানা দেশ থেকে চা কিনে তারা সরবরাহ করে। বাংলাদেশে তাদের হয়ে চা কেনার কাজটি পেলাম। আমাদের পাটকলের একটা হিসাব ছিল উত্তরা ব্যাংকের সঙ্গে। ব্যাংকের কাছে চাইলাম শূন্য থেকে শীর্ষে
৫০ লাখ টাকার ঋণ। মেজবাহ উদ্দীন সাহেব তখন উত্তরা ব্যাংকের মুখ্য ব্যবস্থাপক। তিনি ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু ঋণের মার্জিন ২০ শতাংশ। এর অর্থ হলো আমার নিজের থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ঋণের প্রস্তাবটি গেল ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে। উত্তরা ব্যাংকের এমডি তখন মুশফিকুর সালেহীন। অনেক নামকরা মানুষ। তিনি আমার বাবাকে চিনতেন। বাবা কেমন আছেন জানতে চাইলেন। উঠল মার্জিনের প্রসঙ্গটি।
সালেহীন সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, মার্জিন ১০ শতাংশ থাকুক। আমার তো তখন চরম আর্থিক সংকট। তাই আমি বললাম, আমার কাছে টাকা নেই। আমি ১০ শতাংশ মার্জিন দিতে পারব না। তিনি এবার বললেন, ঠিক আছে, ৫ শতাংশ দিন। আমি এবার মরিয়া হয়েই বললাম, আমার কাছে কোনো টাকাই নেই। তিনি বললেন, আচ্ছা, কোনো মার্জিনই লাগবে না। সেই ৫০ লাখ টাকা নিয়ে আমি চা কেনা শুরু করলাম।
চট্টগ্রামে একটা অফিস নিলাম। শুরু হলো নতুন ব্যবসা। এর ঠিক ১৪ বছর পর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) একটি বড় প্রতিনিধি দল গেল চীন, জাপান ও কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশে। সেখানে সালেহীন সাহেবও ছিলেন। সিউল এয়ারপোর্টে আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, আজ আমার যা কিছু অর্জন, তা আপনার জন্যই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, সেদিন কেন আপনি আমাকে শূন্য মার্জিনে ঋণ দিয়েছিলেন। এভাবে তো ঋণ দেওয়া হয় না।
তিনি জবাব দিয়েছিলেন, আমার বাবাকে তিনি চিনতেন। তার সুনাম, ব্যাংক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার কথা জানতেন। সেই বাবার ছেলে বলেই বিশেষ সুযোগটি দিয়েছিলেন। তারপর সালেহীন সাহেব আরও একটি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ১৪ বছর হয়ে গেল। আপনার প্রতি যে আস্থা রেখেছিলাম, তার প্রতিদান দিয়েছেন। এখন যদি আপনার ছেলে আমার কাছে আসে, আমি তাকেও এভাবে ঋণ দেব।
এবার আমরা চলে যেতে পারি আরও বেশ কয়েক বছর সামনে। ২০১২ সালের ৭ মে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি হিসেবে এ মানুষটির হাতেই তুলে দেওয়া হলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড। তিনি লতিফুর রহমান, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান।
জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার গল্প : গুলশানে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে বসে লতিফুর রহমান বলছিলেন ফেলে আসা জীবনের গল্প, উঠে আসার গল্প। তিনি মনে করেন, সেই যে মুশফিকুর সালেহীন বিনা শর্তে ৫০ লাখ টাকার ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটিই তার জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল সেই এক ঘটনায়। অথচ এভাবে ঋণ নেওয়ার কথা ছিল না। বলতে গেলে, সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্ম নিয়েছিলেন। অর্থ কখনোই কোনো সমস্যা ছিল না। বললেন, ‘সেই ১৭ বছর বয়সে আমার একটা নিজস্ব গাড়ি ছিল। ছোট একটা ফিয়াট। আমাদের পাটের বড় ব্যবসা ছিল। বাঙালির তৈরি করা প্রথম পাটকলটি ছিল আমাদের। আর ছিল চা-বাগান। গুলশানে নিজের বাড়ি হয় সেই ১৯৭০ সালেই।’ তারপরও স্বাধীনতার পর সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছে।
সে এক কঠিন সময় : মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবকিছু জাতীয়করণ করা হয়। এর মধ্যে পাটকলও ছিল। কেবল চা-শিল্পে হাত দেওয়া হয়নি। তখন বেশির ভাগ চা-শিল্পের মালিকানা ছিল ব্রিটিশদের। এ কারণেই হয়তো জাতীয়করণের আওতায় এই শিল্প পড়েনি। সে সময় চা পুরোটাই যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বাইরের সঙ্গে ব্যবসা করার কোনো সুযোগ ছিল না, কীভাবে চা রপ্তানি করতে হয়, তাও জানা ছিল না। লতিফুর রহমান বললেন, ‘রাতারাতি আমাদের অবস্থা পাল্টে গেল। এটা ঠিক, আমাদের বাড়ি ছিল, চা-বাগান ছিল। কিন্তু হাতে কোনো নগদ টাকা ছিল না। বিক্রি করতে পারছিলাম না বলে চায়ের স্তূপ জমছিল। তখন আমার একটা অফিস ছিলÑ ৫২ মতিঝিল। কিন্তু জাতীয়করণ করায় অফিসের ফার্নিচার পর্যন্ত সরকারি সম্পদ হয়ে গেল।
কোনো স্থায়ী সম্পদ নয় : কঠিন একটা সময়ে নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও লতিফুর রহমানের মনোজগতে এর ছাপ রয়ে গেল। সে কথা অকপটে মেনেও নিলেন, ‘আমার মধ্যে প্রথম যে ভাবনাটা এলো, তা হচ্ছে, অর্থই সবকিছু নয়। হঠাৎ করে সব চলে যেতে পারে। আরেকটা ভাবনা আমার মধ্যে গেঁথে গেল, কোনো স্থায়ী সম্পদে আর কখনো বড় বিনিয়োগ করা যাবে না।
১৯৭২ সালে লতিফুর রহমান যখন সবকিছু নতুন করে শুরু করেছিলেন, তখন তার সঙ্গে কাজ করতেন মাত্র পাঁচজন। ট্রান্সকম গ্রুপে এখন কাজ করছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করেছিলেন তিনি। এখন এই গ্রুপের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। গত বছর ট্রান্সকম গ্রুপ ৫৫১ কোটি টাকা কর (আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও আমদানি শুল্ক মিলিয়ে) দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে তা ১০০ বছর পরও টিকে থাকে। তাহলেই মনে করব কিছু একটা করলাম আমি।’ ১০০ বছর টিকে থাকার জন্য নিজস্ব কিছু ভাবনাও আছে লতিফুর রহমানের। আর সেটি হচ্ছে আধুনিক ব্যবস্থাপনা। প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু একটি চেকেও তিনি নিজে সই করেন না। তিনি বললেন, ‘আমার নীতি হচ্ছে, সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে এসে তাকেই পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। তাকে সম্মান দিতে হবে। আমার প্রতিষ্ঠান সেভাবেই চলে। এভাবে না চললে তো সব প্রতিষ্ঠান পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, ব্যবস্থাপনার মানও হতে হবে বিশ্বমানের। আমি সেভাবেই চেষ্টা করছি।’
জীবনের আরেক গল্প : লতিফুর রহমানের জীবনে ছোট্ট আরেকটি গল্পও আছে। পড়তেন শিলংয়ে। কাছাকাছিই থাকতেন শাহনাজ রহমান। তখনই পরিচয়, তারপর সম্পর্ক। তারা বিয়ে করলেন ১৯৬৫ সালে। তারপর দুজনই চলে এলেন ঢাকায়। দীর্ঘ ৪৭ বছরের সংসারজীবন। এক মেয়েকে হারিয়েছেন। এখন এক ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে পুরো পরিবার।
লতিফুর রহমান বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক এই সংঘাত সবসময় থাকবে না। সময়ের পরিক্রমায় এসব চলে যাবে। কেননা তরুণরা এগিয়ে আসছে। তার সবচেয়ে বেশি আস্থা এ তরুণ প্রজন্মের প্রতিই। গভীর প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে, এটি আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’