অনভিজ্ঞ চালকের হাতে চলছিল লঞ্চটি
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ০১, ২০২০
বুড়িগঙ্গায় ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনার সময় মূল মাস্টার ছাড়াই ‘ময়ূর-২’ চালাচ্ছিলেন একজন শিক্ষানবিশ। বেতন কম দিতে অভিজ্ঞ চালকের বদলে অনভিজ্ঞ চালক দিয়েই লঞ্চটি চালাচ্ছিল কর্তৃপক্ষ। মর্নিং বার্ড লঞ্চটি পরিচালনার ভারও ছিল অদক্ষ চালকের হাতে। গত সোমবার ঢাকা-চাঁদপুর রুটের ‘ময়ূর-২’ লঞ্চের ধাক্কায় ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ রুটের অর্ধ-শতাধিক যাত্রীবাহী ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ লঞ্চ ডুবে মোট ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দায় ছিল দুটি লঞ্চেরই। জানা গেছে, সার্ভে সনদে একজন করে দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার ও ড্রাইভার থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে অভিজ্ঞ মাস্টার ও ড্রাইভার ছাড়াই লঞ্চটি চালিত হচ্ছিল।
সার্ভে সনদ ও ফিটনেস নেওয়ার সময় নৌ অধিদফতরে জমা দেওয়া কাগজে-কলমে একজন দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার ও একজন ড্রাইভার দেখানো হয়। কিন্তু সোমবার সকালে কেরানীগঞ্জের একটি ডকইয়ার্ড থেকে মেরামত শেষে ময়ূর-২ নদীতে নামানোর সময় ‘এমভি মর্নিং বার্ডের ওপর তুলে দেয় লঞ্চটি। এ সময় ওই লঞ্চে কোনো মাস্টার ড্রাইভার ছিল না। অনভিজ্ঞ ওই মাস্টারের ভুলেই এ ঘটনা ঘটে। এদিকে দুর্ঘটনার সময় যাত্রীবাহী মর্নিং বার্ড লঞ্চটি পরিচালনার ভারও ছিল অদক্ষ চালকের হাতে। ওই চালকের অদক্ষতার কারণে `ময়ূর-২’ লঞ্চকে আসতে দেখলেও মর্নিং বার্ডকে সঠিক নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি চালক। আরও জানা গেছে, দুটি লঞ্চেরই সনদ ছিল না।
ফলে দুই লঞ্চ চালকের অসতর্কতায় চোখের পলকে এতগুলো প্রাণের সলিল সমাধি ঘটে। দুর্ঘটনার পর থেকে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক ও মাস্টারসহ সব স্টাফ পলাতক। এ দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সাত সদস্যবিশিষ্ট ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র, পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভয়াবহ ওই লঞ্চ দুর্ঘটনার পর সোমবার রাত পর্যন্ত ৩২জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ডুবে যাওয়া ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চ থেকে গত মঙ্গলবার দুপুরে উদ্ধার করা হয় অচেনা এক কিশোরের মরদেহ। লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৩ জনের লাশ উদ্ধারের পর মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে এমভি মর্নিং বার্ড উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। এ সময় ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, র্যাব ও নৌ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন জানান, ডুবে যাওয়া লঞ্চ মর্নিং বার্ডকে টেনে সদরঘাটের কুমিল্লা ডকইয়ার্ডের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভেতরে আর কোনো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
তবে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণার আড়াই ঘণ্টা পর বুড়িগঙ্গায় ভেসে ওঠে আরেকটি মৃতদেহ। তাকে নিয়ে এই লঞ্চডুবিতে উদ্ধার হওয়া মরদেহের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৪ জনে। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন জানান, মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে একজন পুরুষের মৃতদেহ দুর্ঘটনাস্থলের ৫০ গজের মধ্যে ভেসে ওঠে। রাত ৮টা পর্যন্ত মৃতদেহটি কেউ শনাক্ত করেনি। লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে ৩২ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই সোমবার রাতে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গের মাঠ থেকে স্বজনদের কাছে পুলিশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে লঞ্চডুবির ১৩ ঘণ্টা পর সোমবার রাতে সুমন ব্যাপারী নামে একজন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তিনি বর্তমানে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পানির নিচে ১৩ ঘণ্টা বেঁচে থাকার শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ের বর্ণনা দিয়েছেন মর্নিং বার্ডের যাত্রী সুমন। তার এ অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এ ঘটনায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে এখন ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্যের ঝড় বইছে। অনেকেই বলছেন, ঘটনাটি মিরাকল, কেউ বলছেন ঘটনা সাজানো। কেউ আবার বলছেন এটি বিজ্ঞানের বিস্ময়। বুড়িগঙ্গায় অর্ধ-শতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চডুবির ঘটনায় সোমবার রাতেই অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ এনে এমভি ময়ূর-২ লঞ্চের মালিকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে।
জানা গেছে, ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ ছোয়াদ ঢাকার বাসিন্দা। হানিফ ছোয়াদের কোম্পানির নাম সি-হর্স করপোরেশন। তিনি ময়ূর-২ লঞ্চের রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন এই কোম্পানির নামে। আর ডুবে যাওয়া ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চের মালিক মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন ও আব্দুল গফুর। ‘তালতলা ওয়াটার ওয়েজ’ কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা মর্নিং বার্ড লঞ্চের। ময়ূর-২ লঞ্চের চালক শিপন হাওলাদার বেশ কিছুদিন ধরেই ছুটিতে রয়েছেন। শিপন জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি লঞ্চে ছিলেন না। তার অবর্তমানে ময়ূর-২ চালাচ্ছিলেন লঞ্চের মাস্টার।