ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাঠ প্রশাসনের প্রকৃত দুর্নীতিবাজ অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি

তোফাজ্জল হোসেন
🕐 ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ০৬, ২০২০

করোনার মাঝেও জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি ও অনিয়মে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। গত তিন মাসে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ৮৫ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপের সুযোগ নিচ্ছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এখন জনপ্রতিনিধিদের জনসেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত করে মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা আধিপত্য বিস্তার করছেন। যারা দুর্নীতি প্রতিরোধ করবে তারাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মীদের দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনপ্রতিনিধিদের হয়রানি করা হচ্ছে। সুযোগ বুঝে মামলাও দেওয়ার নজির রয়েছে। অভিযুক্ত কয়েকজন জনপ্রতিনিধি মাঠ প্রশাসনের ‘দুর্নীতিবাজ’ অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তদন্ত করলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে।

জানা গেছে, ২০১২ সালের একটি মামলা সামনে এনে নঁওগা জেলার বদলগাছী উপজেলা চেয়ারম্যানকে বরখাস্তও করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ইউএনওদের দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাঠপ্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার ফায়দা হাসিল করার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি দ্রুত ক্ষতিয়ে দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদারকি করলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৪ মে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহিরের (ইউএনও) বিরুদ্ধে টেন্ডার ছাড়াই ভবন ভাঙা, দুর্যোগকালীন তহবিল থেকে ত্রাণ বিতরণের নামে পাঁচ লাখ টাকা তুলে এককভাবে ব্যয় করা এবং কৃষকের উপস্থিতি ছাড়াই লটারি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বদলগাছী প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম খান।

এ ঘটনার মাত্র চার দিন পর গত ১৮ মে সোমবার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা-১ শাখা থেকে উপসচিব নুমেরী জামান স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডিএম এনামুল হক গত ১৪ মে নওগাঁর জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শামসুল আলম খানের বিরুদ্ধে বদলগাছী থানায় জিআর ২/১১ (বদল) তারিখ ৩ জানুয়ারি ২০১১ মামলা রয়েছে যা নওগাঁ বিজ্ঞ দায়রা জজ, দ্বিতীয় আদালতে বিচারাধীন (মামলা নম্বর ৪২৮/১১ দায়রা)।

প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ মে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ [উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১১ এর ১৩ (খ) ধারা অনুযায়ী শামসুল আলম খানকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং প্যানেল চেয়ারম্যান-১-কে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে নিজে কিছুই জানেন না স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডিএম এনামুল হক। তিনি গতকাল দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। কে বা কারা আমার নাম ব্যবহার করে অভিযোগ করেছে, তা তদন্ত করলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

বরখাস্ত হওয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম খান বলেন, যে অভিযোগে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তা ২০১১ সালের ঘটনা। ওই অভিযোগে যদি আমাকে বরখাস্ত করা হয়, তাহলে ২০১৯ সালে ভোট করতে দেওয়া হলো কীভাবে। আমার প্রার্থিতা বাতিল হলো না কেন? ইউএনওর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করায় আমাকে হেনস্তা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ইউএনও মুহা. আবু তাহির বলেন, উনি আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। এরপরে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে সরকার সে বিষয়টি আমাকে অবহিত করেছে।

এদিকে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে উপজেলার চেয়ারম্যানসহ ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। সকল বরাদ্দে তার ঘুষ গ্রহণের ঘটনা ওপেন সিক্রেট। গরিব মানুষের জন্য সরকারের অতিদরিদ্র কর্মসূচিতেও তিনি ঘুষ নেন ১৫ শতাংশ। ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের (১%) নয় মাস ধরে জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদে বরাদ্দ বন্ধ রেখেছেন। ওই ইউএনওর প্রতি জেলা প্রশাসকের আশীর্বাদ থাকার ফলে তিনি এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এমন অভিযোগ তাদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগ দেন হুমায়ুন কবির। ৩০ ব্যাচের এই কর্মকর্তা এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেভিনিও ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়াও রায়পুরা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে কাজ করেছেন তিনি।

ইউএনও হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের প্রশ্রয়ে ঘুষ গ্রহণ, অর্থ আত্মসাৎসহ সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ও পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকা-ের নামে ব্যাপক সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ আনে শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৯টি ইউনিয়নের সকল চেয়ারেম্যান। একই সঙ্গে সরকারের সুনাম রক্ষায় দুর্নীতিবাজ ইউএনওর বদলির দাবি করে

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে।

লিখিত অভিযোগে শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খান বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ থেকে ১০% হারে, এলজিইডি শাখা থেকে ৫% হারে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কাছ থেকে ১৮% হারে, প্রতি নামজারিতে ২ হাজার টাকা, পৌরসভার উন্নয়ন কাজে ২০% হারে, বালি উত্তোলনে প্রতি ট্রাক ৫০০ টাকা সরাসরি ঘুষ গ্রহণ করে।

তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের জন্য দুইবার জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ডিসির আশীর্বাদ থাকায় তদন্ত কর্মকর্তা তার দুর্নীতির কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

গত ২ ফেব্রুয়ারি আরেকটি অভিযোগ জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদের উপসচিব সাইফুল ইসলাম। কিন্তু জেলা প্রশাসকের আস্থাভাজন কর্মকর্তা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হবে না মর্মে আশঙ্কা ভুক্তভোগীদের।

এ বিষয়ে শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খান বলেন, হুমায়ুন কবির একজন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ। প্রতিটি দফতরে তিনি নিজ ইচ্ছামাফিক কাজ করেন। ঘুষ না দিলে কোনো কাজ হয় না। সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের কাজ থেকেও তাকে ঘুষ দিতে হয়। অন্যথায় তিনি ফাইল আটকে রাখেন। আমার জীবনে অনেক ইউএনও আমি দেখেছি। কিন্তু এমন দুর্নীতিবাজ অফিসার কখনো দেখিনি বলে হতাশা প্রকাশ করেন এই জনপ্রতিনিধি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। নিয়ম মেনেই সব কাজ করা হয়েছে। এ সব অভিযোগের ভিত্তি নেই। কাজ করলে নানা ধরনের সমালোচনা নিয়ে সেবার কাজ করতে হবে।

এদিকে কক্সবাজারের পেকুয়ায় ত্রাণের ১৫ টন চাল আত্মসাতের ঘটনায় ইতিমধ্যেই তদন্ত শেষ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। গত ৪ মে দিনভর পেকুয়ার সকল চেয়ারম্যান, ইউপি সচিব, পিআইও ও উপজেলার কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য নিয়েছেন তদন্ত কমিটি। এরপর গত ১০ মে ২য় পর্যায়ে এ বিষয়ে অধিকতর শুনানির জন্য পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে তলব করে।

এরই মধ্যে পেকুয়া উপজেলার বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান বাদে বাকি ৬ ইউপি চেয়ারম্যান ইউএনও সাঈকা শাহাদাতের কর্মকা- তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। একই অভিযোগ দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবও।

সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটি বেশ কয়েকজন বেসরকারি ভুক্তভোগীর বক্তব্যও নিয়েছেন। তারাও বিভিন্ন সময় পেকুয়ার আলোচিত উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ঘুষ দেওয়ার মত স্পর্শকাতর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও পেকুয়া উপজেলার বহিষ্কৃত চেয়ারম্যান বাদে বাকি ৬ ইউপি চেয়ারম্যান পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈকা শাহাদাতের কর্মকা- তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি আবেদন করেছেন।

এদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব যৌথভাবে ‘দুর্নীতিবাজ’ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের আবেদন জানান। তদন্তকারীদের কাছে সাক্ষ্য দেওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে বুঝা যায় তদন্ত কমিটির কাছে যত অভিযোগের তীর ইউএনওকে ঘিরেই।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ৬০ হাজার জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৮৫ জন বরখাস্ত এটি খুব বড় বিষয় না। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের পাশে যেভাবে দাঁড়ানো দরকার সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, দেশে একটা তোষামোদের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ফলে জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে জনগণের সমস্যা তুলে না ধরে তোষামুদিও কাজে ব্যস্ত। ফলে এ সকল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এখন উচিত হবে স্বাস্থ্যসেবার অনিয়ম দুর্নীতির দিকে নজর দেওয়া। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগসহ মাঠ প্রশাসনে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

 
Electronic Paper