ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আইসিইউ সংকট, হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি

তুষার রায়
🕐 ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ, জুন ০৪, ২০২০

দেশে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। আক্রান্ত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হয়ে উঠছে আইসিইউ সংকট। করোনা চিকিৎসার পরিধি সরকার অনেক বাড়ালেও সংকট আড়াল করা যাচ্ছে না। শুধু করোনার জন্য বিশেষায়িত জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অনেক রোগী প্রয়োজনীয় সাপোর্ট না পেয়ে মারা গেছেন।

আইসিইউ সংকটে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপের এক পরিচালকসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী মারা গেছেন। অনেক চিকিৎসক নিজেদের হাসপাতালেই আইসিইউসেবাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একটা অশনি সংকেত। খোদ চিকিৎসক, পদস্থ কর্মকর্তা, শীর্ষ ব্যবসায়ীদের যদি এই পরিণতি হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে? কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে আশ্বাস দিলেও বাস্তব চিত্র এখনও সন্তোষজনক নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রত্যেক জেলার হাসপাতালে আইসিইউ চেম্বার তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে যথাক্রমে ৫০৮ এবং ৭৩৭টি আইসিইউ বেড রয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিভিন্ন জেলায় আইসিইউ সংযুক্ত আধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন অনুসারে গড়ে ওঠেনি। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম (৬৫) চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের বড় ভাই। ওই সময় কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর আসে মোরশেদুলের আরেক ভাইও একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন আইসিইউতে ভেন্টিলেটর সংকট দেখা দেয়। ফলে এক ভাইয়ের অবস্থার অবনতি হলে সেই ভাইকে তার সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। এভাবে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী যথাযথভাবে করোনা চিকিৎসাসেবা পাননি প্রয়োজনীয় সাপোর্টের অভাবে।

করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে থাকা চিকিৎসকরাই চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। গত সোমবার নিজের মালিকানাধীন হাসপাতালে করোনা চিকিৎসাসেবা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন চিকিৎসক লৎফুল কবির শিমুল। এদিকে সোমবার করোনায় প্রাণ হারান বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি চিকিৎসক ওয়াহেদুজ্জামান খন্দকার। অনেক চেষ্টা করেও ওই হাসপাতালে আইসিইউ পাননি। দেশে প্রথম করোনায় প্রাণ হারানো চিকিৎসক ডা. মো. মঈন নিজের প্রতিষ্ঠানের আইসিইউ ও সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাননি।

এভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরাও করোনা চিকিৎসায় আইসিইউসেবা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, সেক্ষেত্রে সাধারণ রোগীরা সীমাহীন ভোগান্তিতে রয়েছেন। তারা অনেক ক্ষেত্রে জানতে পারছেন না, তাদের সঙ্গে কি করা হচ্ছে। বিভাগীয় শহরগুলোতেও সাধারণ মানুষ এসব আধুনিক সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, তারা পর্যাপ্ত আইসিইউ সেবা পাচ্ছেন না, রয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকট। গ্রাম থেকে আসা রোগীর স্বজনরা একটা আইসিইউ বেড বা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করছেন, অপেক্ষা করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু মিলছে না এ সেবা। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু ঘটছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত চাহিদার তুলনায় আইসিইউ বেডের তীব্র সংকট। করোনা রোগীর সংখ্যা যত বাড়ছে আইসিইউয়ের চাহিদা তত বাড়ছে। কিন্তু রাতারাতি এ ধরনের সেবা বাড়ানো যায় না। তাছাড়া আইসিইউ সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ সাপোর্টিং স্টাফ নেই।

পরিস্থিতি বিবেচনায় হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ এবং প্রত্যেক জেলা হাসপাতালে স্বয়ংসম্পূর্ণ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) দ্রুত নিশ্চিতের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার একনেক সভায় এ নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী উচ্চতর অগ্রাধিকার দিয়েছেন জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনে। তিনি বলেছেন, প্রতিটি জেলা হাসপাতালে শুধু আইসিইউ স্থাপন নয়, আইসিইউতে যেসব যন্ত্রপাতি থাকার কথা, সেগুলো সরবরাহ করতে হবে। অতি জরুরিভিত্তিতে এগুলোকে আপডেট করতে হবে। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। এদিন তিনি জরুরিভিত্তিতে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দেন। প্রকল্প দুটির একটি কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড পেন্ডামিক প্রিপেয়ার্ডনেস। অপরটি কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স।

জানা গেছে, গত ১৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি চিঠিতে বলা হয়, বেশিরভাগ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন করা হলেও আইসিইউগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অক্সিজেন সরবরাহ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। হাসপাতালে ভেন্টিলেটর বরাদ্দ করা হলেও আইসিইউ পরিচালনার জন্য ১২ ধরনের সরঞ্জামের প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে কার্যকর আইসিইউ দরকার। আইসিইউয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভেন্টিলেটর ফুসফুসের সমস্যায় ভোগা রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করে। এগুলো করোনা রোগীদের বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, করোনাভাইরাস শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে।

গত মাসে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-চীন যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ আক্রান্ত পাঁচ শতাংশ রোগীর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয় এবং আরও ১৫ শতাংশের জন্য প্রয়োজন হয় ঘনীভূত অক্সিজেন। যার অর্থ প্রায় ২০ শতাংশ রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে আশ্বাস দিলেও বাস্তব চিত্র এখনও সন্তোষজনক নয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সব হাসপাতালে সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসা সেবা চালু করতে না পারাও এ সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। হাসপাতালগুলোর আইসিইউ পরিচালনার জন্য চিকিৎসক ও নার্সের পাশাপাশি অ্যানেসথেশিস্ট নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। টেকনেশিয়ানদেরও দক্ষতা বাড়াতে হবে।’

 
Electronic Paper