সফল উদ্যোক্তার প্রতীক আবদুল মোনেম
আলতাফ হোসেন
🕐 ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ, জুন ০২, ২০২০
আবদুল মোনেম লিমিটেডের (এএমএল) প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মোনেম ছিলেন শিল্প বিকাশে সফল উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম দিকপাল। তিনি রোববার সকালে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের দক্ষিণ দিকে মায়ের কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন আবদুল মোনেম।
আবদুল মোনেম লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইগলু আইসক্রিম, ফুড অ্যান্ড ডেইরির গ্রুপ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জি এম কামরুল হাসান জানান, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে আবদুল মোনেমের মৃত্যু হয়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় গত ১৭ মে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি কিডনি রোগেও ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। আবদুল মোনেম দেশের প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব। বিনয়ী ও পরিশ্রমী এই মানুষটি মেধা ও সততা দিয়ে দেশের বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন সুনামের সঙ্গে। অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘রাষ্ট্রপতি শিল্প উন্নয়ন পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।
বেসরকারি খাতে শিল্প স্থাপন, পণ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অত্যন্ত দক্ষ ও দূরদর্শী এই উদ্যোক্তা যৌবনের স্বর্ণালি সময়সহ তার জীবনের পুরোটাই ব্যয় করেছেন প্রিয় মাতৃভূমির বৃহৎ সব নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে। চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন হাসি মুখে। প্রাণান্ত চেষ্টা আর অধ্যবসায় দিয়ে অসম্ভব প্রকল্পকে দেখিয়েছেন সাফল্যের মুখ। আবদুল মোনেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোনেম তার সুযোগ্য দুই সন্তানকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন যোগ্য নেতৃত্ব। এএসএম মইনউদ্দিন মোনেম এবং অন্যজন মহিউদ্দিন মোনেম প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা যায়, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ১৯৫৬ সালে এএমএল কনস্ট্রাকশন্স দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর একে একে গড়ে তোলেন বিভিন্ন শিল্পকারখানা। সফল ব্যবসায়ী কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপে পরিণত হয়েছে কোম্পানিটি।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, আবদুল মোনেম লিমিটেডের যাত্রা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে স্থাপন হয়েছে আলাদা শিল্প ইউনিট। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে আইসক্রিম ও বেভারেজ, ২০০০ সালে ম্যাঙ্গো পাম্প প্রসেসিং, ২০০৪ সালে ঈগলু ফুডস, ড্যানিস বাংলা ইমালশন, সিকিউরিটি ও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ঈগলু ডেইরি প্রোডাক্টস, ২০০৭ সালে সুগার রিফাইনারি ও এম এনার্জি, ২০০৮ সালে নোভাস ফার্মাসিউটিক্যালস, ২০১০ সালে এএম অ্যাসফল্ট অ্যান্ড রেডিমিক্স, ২০১২ সালে এএম অটো ব্রিকস, ২০১৪ সালে এএম ব্র্যান্ড অয়েল কোম্পানি।
এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে হয়েছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চরবাউশিয়ায় ‘আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল’। এর পাশাপাশি আবদুল মোনেম লিমিটেড অর্থনৈতিক সেবা, প্রযুক্তি খাতে আউটসোর্সিং, কর্মশক্তি সরবরাহকারী হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। গ্রাহকদের জন্য উন্নত পণ্য তৈরিতে ও তাদের সেবাদানে এএমএল-এ ১৫ হাজার দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিরলসভাবে কাজ করছেন।
আইসক্রিমের পাশাপাশি দুগ্ধজাত ও খাদ্যপণ্যে বাজারের চাহিদা পূরণে যাত্রা শুরু করে ঈগলু ডেইরি ও ঈগলু ফুডস লিমিটেড। দৈনিক ৫ হাজার লিটার থেকে শুরু করে বর্তমানে ঈগলু ডেইরি লিমিটেড প্রতিদিন ১৪ হাজার লিটার দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করছে। দুগ্ধজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে গুঁড়া দুধ, ইউএইচটি, এফসিএমপি, ঘি ও বাটার। শ্যামপুর ও নারায়ণগঞ্জে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ছাড়াও বাঘাবাড়ি ও সিরাজগঞ্জে রয়েছে মিল্ক কালেকশন সেন্টার। এএমএলের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ঈগলু ফুডস লিমিটেড হিমায়িত খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিতরণ করে আসছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খাবার ও স্ন্যাক্সও তৈরি করে এএমএল।
ড্যানিশ বাংলা ইমালশন লিমিটেড (ডিবিইএল) আবদুল মোনেম লিমিটেড ও ডেনমার্কের ইএনএইচ ইঞ্জিনিয়ারিং এ/এস-এর একটি যৌথ উদ্যোগ। সড়ক ও বিমান ঘাঁটি পথ নির্মাণে স্বয়ংক্রিয় ও অত্যাধুনিক উপায়ে বিটুমিন ইমালসন উৎপাদন করে ডিবিইএল। ডিবিইএল প্রতি বছর ২ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা যোগ করছে দেশের অর্থনীতিতে।
প্রতি বছর দেশে প্রায় ১.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন চিনির প্রয়োজন। এ চিনির বেশির ভাগই উৎপাদন করছে আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড (এএমএসআরএল)।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি করতে এএমএলের রয়েছে এএম অটো ব্রিকস লিমিটেড। মেঘনা ঘাট, ছোট রায়পাড়া, গজারিয়া ও মুন্সীগঞ্জে এএম অটো ব্রিকসের প্লান্ট অবস্থিত। মেঘনা নদীর তীরে ১.৭৩ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এএম এনার্জি লিমিটেড। এছাড়া আবদুল মোনেম লিমিটেডের আরেকটি ব্যবসায়িক অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নোভাস ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
নির্মাণ খাতে দীর্ঘ ছয় দশকের অভিজ্ঞতা আবদুল মোনেম লিমিটেডের। ‘টাচিং লাইভস, বিল্ডিং ক্যাপাবিলিটিস’ সেøাগান নিয়ে দেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট অবকাঠামো, যা আজকের বাংলাদেশে আমরা দেখি, এসবের সিংহভাগেরই নির্মাতা আবদুল মোনেম লিমিটেড। ক্রমেই ব্যবসা ডাইভার্সিফাই হয়েছে।
বিশ্বখ্যাত কোমল পানীয় কোকাকোলা বা ঈগলু’র মতো দুনিয়া জোড়া সুনামের আইসক্রিম ব্র্যান্ড সমৃদ্ধ আবদুল মোনেম লিমিটেড এখন পরিণত হয়েছে আবদুল মোনেম গ্রুপে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দেশ ও সমাজের জন্য বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করছে। আবদুল মোনেম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় অবদানসহ অনাথ আশ্রম চালাচ্ছে যথাযথ সহানুভূতি ও যতেœর সঙ্গে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজেশ্বরে ৫২ একর জমি দান করেছেন।
এখানে বিনামূল্যে শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, অনাথ আশ্রমসহ পানির জন্য একটি বড় পুকুর রয়েছে। এছাড়া জাতীয় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ, গরমের সময় বিনামূল্যে পানীয় জল সরবরাহ, দরিদ্র ও অভাবী গর্ভবতী মায়েদের বিনামূল্যে ভিটামিন সরবরাহ, নিরাপদ পরিবেশের জন্য গাছ লাগাতে উৎসাহিতকরণসহ শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।