ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনাকালেও সুবিধা লুটছে টেলি-কোম্পানিগুলো 

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৬:২৩ অপরাহ্ণ, মে ২৭, ২০২০

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসে অর্থনৈতিক মন্দা তুঙ্গে। এতে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের জীবনে পড়েছে ভয়াবহ প্রভাব। যার যা আছে তাই নিয়ে জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছে অনেকে। দেশের প্রায় তিন কোটি নিম্নআয়ের মানুষ সরকারি ত্রাণ ও বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ কাজে তেমন কোনো সহযোগিতার হাত বাড়াতে দেখা যায়নি বিপুল অর্থ মুনাফা করা দেশের টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলোকে।

দিন শেষে যে মানুষটির ত্রাণের প্যাকেট না পেলে পেটে ভাত জোটে না, তাকেও নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মাসে উল্টো বিল গুনতে হচ্ছে। লকডাউনে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তেও বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক কল রেট ও ডাটা বিক্রি করে বেশি মুনাফা করছে তারা। সাধারণ জনগণকে সুবিধা দেওয়া তো দূরের কথা এ পর্যন্ত কোনো কোম্পানিকে দৃশ্যত লকডাউনে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি।

যতটুকু ফ্রি মিনিট গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে এটাও তাদের বাণিজ্যের একটা অংশ ছিল বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, জর্ডান এমনকি আমেরিকার নাগরিকরাও বিনামূল্যে ডেটা ব্যবহার ও লোকাল কল বিনামূল্যে করার সুযোগ পাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের মানুষ সমানতালে গুনছে মোবাইল বিল ও ডেটা খরচ। এমনকি আন্তর্জাতিক কলরেট কমানো হলেও এর থেকে সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে এদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে গ্রামীণফোন তাদের দেড় জিবি ইন্টারনেট ব্যবহারে নিতো ২৪৭ টাকা, এক জিবি ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়েছে ১৮৯ টাকা। তাদের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলাকালীনও একই পরিমাণ ডেটার ব্যবহারে নেওয়া হচ্ছে পূর্বের সমপরিমাণ টাকা। অর্থ্যাৎ লকডাউনকালীন সময়ে তারা কোনো ছাড় দেয়নি তাদের ডেটা খরচে।

'গ্রামীণফোনের ১০ কোটি মিনিট ফ্রি টকটাইম দেওয়ার ঘোষণা এক ধরনের হাস্যরস'

এ বিষয়ে প্রতিবেদকের কথা হয় বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আমরা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে একটি চিঠি দিয়েছি লকডাউনে থাকা গ্রাহকদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের। কিন্তু আজ পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কমিশন।

তিনি আরও বলেন, দেখুন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি এক লাখ গ্রাহকের জন্য ব্যবহার করা হয় এক মেগাহার্ডজ তরঙ্গ। অথচ বাংলাদেশে এক মেগাহার্ডজ তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় ২২ লাখ গ্রাহকের জন্য। এখানে কতটা সুবিধা বঞ্চিত এদেশের ডেটা ব্যবহাকারীরা? প্রশ্ন তোলেন তিনি।

আক্ষেপ প্রকাশ করে মহিউদ্দিন বলেন, লকডাউনের সময় যেখানে গ্রামীণফোনের উচিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ঠিক সেই সময় তারা তাদের সিলিং (সর্বোচ্চ) চার্জ প্রতি মিনিট দুই টাকা করে আদায় শুরু করে। সারাদেশে মহামারিতে যখন সব ধরনের ব্যবসা ধ্বংসের পথে তখন তারা এক ধাপে এক হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করল। সেই টাকা দিয়ে তারা বিটিআরসির কাছে থাকা ঋণের টাকা পরিশোধ করলো।

গ্রামীণফোনের দেওয়া ২৫ হাজার ডাক্তারদের ডাটা ফ্রি সার্ভিসের ঘোষণা অযৌক্তিক মনে করে গ্রাহকদের অধিকার আন্দোলনে থাকা এই সংগঠক বলেন, এসব ডাক্তার ১২ ঘণ্টা হাসপাতালে ডিউটি করে এবং তাদের থাকার যেসব ফোর-স্টার, ফাইভ-স্টার হোটেল আছে সেখানেতো এমনিতেই ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। বরং এই ডাটা ফ্রি সুবিধা দরকার ছিল অনলাইনে বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা সংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।

তার দাবী, গ্রামীণফোনের ১০ কোটি মিনিট ফ্রি টকটাইম দেওয়ার ঘোষণা এক ধরনের হাস্যরসে পরিণত হয়েছে। যে সময়ে ব্যবহারের জন্য তারা এ অফার দিয়েছে রোজার কারণে মানুষ সেই সময় বিশ্রাম করে।

জানা গেছে, লকডাউনের আগে যেখানে প্রতিদিন এক হাজার গিগাবাইট ইন্টারনেট ব্যবহার হতো, সেখানে লকডাউনে তা বাড়িয়ে হচ্ছে ১৭ হাজার গিগাবাইট পর্যন্ত। এর ফলে একদিকে ইন্টারনেটের স্পিড কমেছে, অপরদিকে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ডাটা বিক্রির মুনাফা দ্বিগুণ হয়েছে।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের মূল্য ২৭ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৮ হাজার টাকায় নির্ধারণ করে সরকার। পরবর্তীতে ২০১১ সালের এপ্রিলে ১২ হাজার টাকা, ২০১২ সালের এপ্রিলে ৮ হাজার টাকা, ২০১৪ সালের এপ্রিলে ২ হাজার ৮০০ টাকা এবং ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৯৬০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৩৬০ টাকায় কমিয়ে আনা হয়।

সর্বশেষ এ বছর ২৭ জুন এক এমবিপিএএস ব্যান্ডউইথের সর্বনিম্ন চার্জ ৩৬০ টাকা থেকে ১৮০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে সরকার দেশের মানুষের কাছে ইন্টারনেট সহজলভ্য করতে ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর পাশাপাশি ভ্যাটের হার কমালেও সেই সুবিধা ভোগ করতে পারছে না মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। এমনকি এতে করে কোম্পানীগুলোর ইন্টারনেট ব্যবসায় গ্রোথ হয়েছে ৩৫ শতাংশ।

আমরা লকডাউনে থাকা মানুষের কল্যাণে সব ব্যবস্থা নিয়েছি: গ্রামীণফোন

এদিকে গ্রামীণফোনের কমিউনিকেশন্স ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ হাসান খোলা কাগজকে জানান, গ্রামীণফোন প্রথম থেকেই এটুআই, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, এনটিএমসি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ব্র্যাকসহ নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছে। গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে ১০০ কোটি টাকার একটি সহায়তা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন অনুসারে সহায়তাগুলো দিচ্ছি। গ্রামীণফোনের সামাজিক মাধ্যমে আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং সমসাময়িকভাবে আমাদের বিভিন্ন প্রচারণা এসব মাধ্যমে প্রচার করেছি। ৫০ হাজার প্রফেশনাল পিপিই (ফুল সেট) সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে বিতরণ করছি।

তার ভাষ্য, গ্রামীণফোন ব্র্যাকের জরুরি খাদ্য সহায়তা তহবিলে ১৫ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দান করেছে। যা ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ পরিবারকে এক হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা দেখেছি এপ্রিল মাসে আমাদের অনেক গ্রাহক রিচার্জ করতে পারেননি বা অনেকের ন্যূনতম ব্যালেন্স নেই বললেই চলে। আমরা এমন শনাক্তকৃত এক কোটি গ্রাহকদের ১০ কোটি মিনিটি ফ্রি টক টাইম দিয়েছি।

সরকারের নির্দেশ, ৪৫ পয়সা রেটের নিচে কল রেট দেয়া যাবে না, আমরা ফ্রি দিব কীভাবে? : বাংলালিংক

বাংলালিংকের কমিউনিকেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা আনকিত সুরেকা খোলা কাগজকে বলেন, আমরা বাংলাদেশ আর্মি এবং সেনা কল্যাণ সংস্থার সঙ্গে ১৪ হাজার ৫০০ ফ্যামিলিকে রিলিফ সাপোর্ট দিয়েছি। আমরা ডেটা প্রাইস প্রতিটি প্যাকেজে ৪০ শতাংশ কমিয়েছি। বাংলালিংক টু বাংলালিংক এসএমএস ফ্রি করে দিয়েছি। একটা টাইম পিরিয়ডে যেসব গ্রাহক রিচার্জ করতে পারছিলেন না তাদেরকে ১০ মিনিট টকটাইম ও ৫০ মেগাবাইট ইন্টারনেট ফ্রি দিয়েছি। গ্রাহকরা লোন চাইলে আগে যে পরিমাণ দেওয়া হতো তার পরিমাণ এখন বাড়ানো হয়েছে।

আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের গ্রাহকের জন্য ফ্রী কল সার্ভিস দিয়েছে, বাংলালিংক এমন সুবিধা দিচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নে বাংলালিংকের এই কর্মকর্তা বলেন, দেখুন এই ধরনের পরিকল্পনা আমরা চাইলেই নিতে পারব না। এক্ষেত্রে রেগুলেটরি কমিশনের একটি নিয়ম আছে, সেই নিয়ম অনুযায়ী ৪৫ পয়সা রেটের নিচে কোনো কল রেট দেয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে আপনি ফ্রি দেবেন কিভাবে? তবে হ্যাঁ সরকার যদি নির্দেশনা দেয় সব অপারেটরকে ফ্রি কল সার্ভিস দিতে হবে, তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়। আমরা নিজেদের মতো করে এ ধরনের কোনো সুযোগ গ্রাহককে দিতে পারবো না। এটা করলে ট্যারিফ কমিশন রেগুলেশন ভায়োলেট হবে।

লকডাউনে মোবাইল অপারেটরেরা সরকারের কাছে কোন সহযোগিতাই চায়নি: মোস্তফা জব্বার

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডাক ও টেলিযোগাযোগের বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করে টেলিকম কোম্পানিগুলোর জন্য কোনো বেনিফিট দেওয়া তখনই প্রয়োজন হবে, যখন আমি দেখব এরা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণফোনের গত বছর থেকে শুরু করে অতীতের রেকর্ড খুঁজে দেখুন তারা কী পরিমাণ প্রফিট করেছে। সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলে তাদের গ্রাহক সুবিধা দিতে হবে এটার কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, আমরা মোবাইল কোম্পানিগুলোকে বলেছি, এই মুহূর্তে তোমরা ডেটাকে এভেলেবেল করো। সরকার এর চেয়ে আর কী করবে? ট্যাক্স-ভ্যাট এর ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর কোনো দাবী থাকলে তারা অর্থমন্ত্রণালয়কে প্লেস করতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় যদি যুক্তিসঙ্গত মনে করে তাহলে বিবেচনা করতেই পারে।

মোস্তাফা জব্বার মোবাইল কোম্পানিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, তারা আজ পর্যন্ত সরকারের কাছে বলেনি আপনারা এক টাকা ছাড় দিন আমরা ৫০ পয়সা এখান থেকে গ্রাহককে দিয়ে দেব। সেটা করলে প্রয়োজনে সরকার বিবেচনা করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া সরকার জরুরি মনে করে না।

দিন শেষে যে মানুষটির ত্রাণের প্যাকেট না পেলে পেটে ভাত জোটে না তাকেও নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মাসে দুই থেকে ৫০০ টাকা মোবাইল বিল গুনতে হয়। এমন প্রসঙ্গে মোস্তফা জব্বার বলেন, এটা মানবিক বিষয় নয়। আপনি মোবাইলে ৫০০ টাকা খরচ করার সময় চিন্তা করে দেখবেন আপনার চাল কেনা দরকার আগে? নাকি মোবাইলে কথা বলা দরকার আগে।

 
Electronic Paper