ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাতৃভাষা দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৭:২২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০

মায়ের ভাষা বাংলার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছে এই বাংলার সন্তানরা। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও নাম নাজানা তরুণরা সেদিন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রচনা করেছেন বাংলা ভাষার অধিকার। একই সঙ্গে ছিনিয়ে এনেছেন পৃথিবীর মানুষের মাতৃভাষার অধিকারও। দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দেওয়া সেই দিন এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রূপ নিয়েছে। বাঙালির পাশাপাশি বিশ্ববাসীরও আজ শ্রদ্ধায় অবনত হওয়ার দিন। দেশে দেশে মানুষের মুক্তি, গণতান্ত্রিক লড়াই, সাম্প্রদায়িকতাসহ সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে অমর চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার দিন আজ। মহান ‘শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ আজ।

হাজার বছরের বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে ভিত্তি রচিত হয়েছিল ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের। যার মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ করেছে বাঙালি জাতি।

একুশের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানরা অনুধাবন করেছিল, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দর্শনে তাদের মুক্তি নয়, বাঙালির হাজার বছরের জাতিগত ইতিহাস, লড়াইয়ের নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐক্যই দিতে পারে সব শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তি। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যে ভ্রুণ গ্রোথিত হয়েছিল সেই থেকেই একের পর এক জন্ম নিয়েছে আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্মারক- ৫৮’এ আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০’এর নির্বাচন এবং সর্বোপরি ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য ছাত্র-জনতা পণ করেছিল তার আগের রাতেই। সিদ্ধান্ত মোতাবেক পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ (আইন পরিষদ) ঘেরাও করার জন্য ছাত্র-জনতা সকালেই রওনা করেছিল আমতলা থেকে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বন্দুকের গুলির মুখোমুখি হয়েছিল কেবলই মায়ের ভাষার দাবিতে। সমবেতভাবে এ ঘোষণার প্রতিবাদ করেন। পরে জিন্নাহ পুনরায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে একই রকম ভাষণ দিলে সমবেত ছাত্ররা তার মুখের উপরেই ‘না না’ বলে চিৎকার করে ওঠেন।

মূলত এ দুই ঘটনা থেকেই শুরু ভাষা আন্দোলনের। তবে এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এ দিন ১৪৪ ধারা না মেনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলায় দলে দলে ছাত্রজনতা জড়ো হয়েছিলেন। মুখে স্লোগান, হাতে ফেস্টুন, বুকে সাহস। মিছিলে প্রকম্পিত হলো রাজপথ-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

কিন্তু ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে পরিস্থিতি মুহূর্তে পাল্টে যায়। একুশ ও বাইশ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পরপর দুই দিন শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যা চালায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনে পেটোয়া বাহিনী। এ দুদিনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও বেশ কয়েকজন।

ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালিয়ে পাকিস্তান সরকার স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল মাতৃভাষার আন্দোলন। কিন্তু শহীদদের খুনে রাঙা রাজপথ অগ্নিশপথে জেগে উঠেছিল। ছাত্রদের আন্দোলন হয়ে উঠে সবার আন্দোলন।

একুশে ফেব্রুয়ারি গুলির ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল সারা দুনিয়া। বহির্বিশ্ব জেনে যায় বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের নৃশংসতার কাহিনী। গুলির প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবি জানাজার পর হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীসহ জনগণ বিশাল মিছিল বের করে। সবার মুখে ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘খুনি নূরুল আমীনের বিচার চাই’, ‘খুনের বদলে খুন চাই’ প্রভৃতি স্লোগান। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল এ মিছিলেও বাধা দেয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। তারা একই সঙ্গে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা শুরু করে।

এসবে দমে না গিয়ে বাংলাপ্রেমীরা চালাতেই থাকেন আন্দোলন। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণের যে জায়গায় প্রথম গুলি হয়েছিল সে জায়গায় ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ, প্রথম শহীদ মিনার। কিন্তু তিন দিন যেতে না যেতেই শাসকরা সেটি ভেঙে ফেলে। এতে আন্দোলনকারীদের আগুনে যেন ঘি পড়ে। আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে বাঙালিরা। শহীদের রক্তে রাঙা একুশের স্মৃতি আর তার স্মারক স্তম্ভ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষোভ-ক্রোধ যেন উন্মাতাল করে তুলে বাঙালিকে। আপামর জনতা যে যার অবস্থান থেকে শরিক হন ভাষার দাবির আন্দোলনে। কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা চালাতে থাকেন কলম।

রচিত হয় অসংখ্য গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখলেন কালজয়ী কবিতা-‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কী বন্ধু, আমরা এখনো/ চারকোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো! আন্দোলনে গ্রেফতার বুদ্ধিজীবীরা জেলখানায় বসে নাটক লিখে সেখানেই তা মঞ্চস্থ করেন। একনায়ক শাসকরা কোনোভাবেই আর দমিয়ে রাখতে পারেনি বাঙালিকে।

বাঙালির মাতৃভাষা দিবস এখন আন্তর্জাতিকভাবে সমগ্র দুনিয়া পালন করে থাকে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার জন্য আত্মত্যাগকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি এ বিশেষ দিবসটিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ প্রথমবারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে।

ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলার দামাল ছেলেদের দুনিয়া কাঁপানো একটি দিন এখন পৃথিবীবাসী গর্বভরে স্মরণ করে থাকে।

দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকায় দিবসের সূচনা হবে ভোরে তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে। অমর শহীদদের স্মরণে সকালে হবে প্রভাতফেরি। সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে শহীদ মিনারে বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরতে আয়োজন করা হবে আলোচনা সভার। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। এর মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

 
Electronic Paper