ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের উদ্যোগ

তোফাজ্জল হোসেন
🕐 ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২০

মামলাজট দ্রুত নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে ‘অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের উদ্যোগ’ নিয়েছে সরকার। শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অ্যাটর্নি পদে স্থায়ী নিয়োগের নির্দেশনা-সংক্রান্ত ইঙ্গিত দিয়েছেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে অ্যাটর্নি সার্ভিস আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অ্যাটর্নি পদে স্থায়ী নিয়োগ হলে সরকারি অফিসগুলোর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে পাঁচ সহস্রাধিক মামলার বোঝা বইছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কেউ গা করেনি। মামলা থাকায় সংকট দেখা দিয়েছে। এসব মামলার কারণে সরকারি চাকরিতে হাজার হাজার পদ শূন্য রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পরও ওই শূন্য পদ পূরণ হচ্ছে না। ফলে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও গতি কমেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দুই যুগ ধরে ঝুলে থাকা স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের জন্য আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর একাধিক চিঠিও পাঠানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর, সংস্থা এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পাঁচ হাজার ৩৭৪টি মামলা আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। যথাযথভাবে এসব মামলার শুনানি করতে না পারায় বা সময়মতো পদক্ষেপ নিতে না পারায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রায় সরকারের বিপক্ষে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময়মতো নজর দিলে এ পরিস্থিতি হতো না। মামলার সংখ্যা বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাষ্ট্রের আইনজীবী, আইন শাখার কর্মকর্তারা থাকার পরও এখন বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। উচ্চ আদালত থেকে আসা এসব মামলার বিবাদী হলেন সচিব এবং বিভিন্ন সংস্থা ও অধিদফতরের প্রধানরা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, চাকরি স্থায়ী ও একীভূতকরণ, পেনশনসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। এসব কাজে বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বঞ্চনার অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেকেই তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর মধ্যে রয়েছে বেতন স্কেল বাড়ানো, পদোন্নতি, দৈনিক ভিত্তিতে এবং প্রকল্পে কর্মরতদের চাকরি স্থায়ীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়। বিভাগীয় পর্যায়েও অনেক মামলা রয়েছে। এসব মামলার কারণে প্রশাসনের শূন্য পদে জনবল নিয়োগ কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

এ বিষয়ে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে এবং প্রায় সব রাষ্ট্রেই এ সমস্যা মোকাবেলায় আইন ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন। আর সরকারের আইন ক্যাডার না থাকায় অজান্তেই প্রতিনিয়ত অনেক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়।

তিনি বলেন, দেশে অস্থায়ী ভিত্তিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় আইন কর্মকর্তা নিয়োগ হয়। এ কারণে সরকার বেশিরভাগ মামলায় হেরে যায়। রাষ্ট্র ও বিচারপ্রার্থী জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইন কর্মকর্তা ছাড়া আইনের শাসন সম্ভব নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরকার আইন ক্যাডারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছে না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইন শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো অধিকতর তৎপরতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের জন্য আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসনে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশ দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, বেসরকারি আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা বছরের পর বছর ধরে এসব কাজ করেনি। এখন রাষ্ট্রীয় টাকা বাড়তি ব্যয় করে আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছে। নিয়োগ পাওয়ার পর এই আইনজীবীদের অনেকেই মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে গাফিলতি করেন। এসব ক্ষেত্রে সরকারপক্ষ বেশিরভাগ মামলায় হেরে যায়। রাষ্ট্রের আইনজীবীরাই বা কী করছেন? বছরের পর বছর এসব মামলা নিষ্পত্তি করেননি? যদিও আইন শাখার কর্মকর্তাদের দাবি- আইনজীবী নিয়োগ না করলে এত মামলার জবাব কোনোভাবেই তাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।

কর্মকর্তারা আরও বলেন, জনপ্রশাসনের মামলা নিষ্পত্তির জন্য বাজেট বরাদ্দও আইন অনুবিভাগে জনবল বাড়াতে হবে। প্যানেল আইনজীবী এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মামলা নিষ্পত্তি হয়নি কেন- এ বিষয়ে তারা বলেন, সবাই আইন শাখায় নতুন। এভাবে স্বল্প সময়ের জন্যই কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়ে থাকেন এবং আইন শাখায় স্থায়ী কোনো জনবল নেই। এ ছাড়া যে কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মরত, তাও চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

গত ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে উচ্চ আদালতে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে মামলা আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার জন্য তিনি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনেরও নির্দেশ দেন। এরপর অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের জন্য আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চিঠি পাঠানোর প্রায় সাত মাস পরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, সরকারি কৌঁসুলিদের মামলা পরিচালনার সুবিধার্থে অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস সহায়তা করছে।

এ বিষয়ে সাবেক আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, অ্যাটর্নি সার্ভিস স্থায়ী করার দাবি দীর্ঘ দিনের। এ ব্যাপারে সরকারের এটি ভালো উদ্যোগ। তবে পাবলিক প্রসিকিউটর ও অ্যাটর্নি সংখ্যায় অনেক বেশি। এ কারণে স্থায়ী করার বিষয়টি কঠিন কাজ। সরকারি অফিসগুলোর মামলা জট সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলার কারণে এই জট। দ্রুত সাক্ষী আনা গেলে তাড়াতাড়ি মামলা শেষ হবে। অনেকেই দ্রুত সাক্ষী আনতে পারে না। এ জন্য সমস্যা হচ্ছে।

এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম গতকাল দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, অ্যাটর্নি সার্ভিসের আইন হওয়া উচিত। সেই আইনে যারা চাকরিতে ঢুকবে তাদের দলের মতের বাইরে রেখে সার্ভিস গঠন করা উচিত। সরকারি তথ্য মতে সাড়ে ৫ হাজার মামলাজট রয়েছে। এ-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, সাড়ে পাঁচ হাজার নয়, সাড়ে পাঁচ লাখ মামলার জট রয়েছে।

 
Electronic Paper