ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

উষ্ণায়নের ঝুঁকিতে দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:২৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০১৮

ভর বর্ষায় যখন দাবদাহে পুড়ছে নগর-জনপদ তখন ঋতুশৃঙ্খলায় যে বড় ধরনের গড়বড় হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। জলবায়ু গবেষকরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ধরনের হ্যাপা সামলাতে হচ্ছে পৃথিবীকে। বিশ্বসংস্থাগুলো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝক্কি বা ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।

গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে বৃষ্টি কম হচ্ছে। যার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে দাবদাহ। তবে দু’একদিনের মধ্যেই এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে জানিয়েছে তারা।
গত বৃহস্পতিবার বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে দেশে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল আর রাজধানী ঢাকায় ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষা মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এসে বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন পার করাটা ছিল জনজীবনের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ৪৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৮ মে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার আগে ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ঢাকায় ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া সর্বশেষ ২০১৪ সালে ২৪ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেদিন ঢাকায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চক্রের নির্ধারিত সময়ে ঋতুগুলোর আচরণ বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তীব্র গরম, আকস্মিকভাবে বজ্রপাতের হার বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের প্রাণহানি, দেরিতে শীতের আগমন, অসময়ে বন্যা, বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বড় ধরনের ঝুঁকির আভাস দিচ্ছে বাংলাদেশকে। যদিও পরিবেশ ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋতুচক্রে অনিয়ম ও ঋতুর অস্বাভাবিক আচরণ গত কয়েক বছরে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঋতুর অনিয়মটাও এখন নিয়ম হয়ে গেছে। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। হাজার হাজার বছর ধরে চলা প্রাকৃতিক নিয়মগুলো প্রাকৃতিকভাবেই পরিবর্তন হয়। এ জন্য আতঙ্কের কিছু নেই।
তবে সচেতনতা এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ এ ধরনের ঝুঁকি থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে গ্রিনহাউস গ্যাস। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত এ গ্যাস পরিবেশ বিপর্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সূর্য থেকে আসা তাপশক্তি পৃথিবী পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং এ বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই আবার ফিরে যায় বায়ুমণ্ডলে। এটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে বায়ুমণ্ডলে। এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি বায়ুমণ্ডলে পুনরায় ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পৃথিবী পৃষ্ঠে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটাকেই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলা হচ্ছে।
গ্রিনহাউস গ্যাস থেকে বাঁচার জন্যবৃক্ষ নিধন, পরিবেশদূষণ, গ্রিসহাউস ইফেক্ট রোধ ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বিপুল পরিমাণ বনায়নই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে বনভূমি আছে মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) চলতি মাসে বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে মোট ভূখণ্ডের মাত্র সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। দেশে বনভূমি ক্রমাগত কমছে-এমন খবর সরকারের তরফ থেকে অস্বীকার করা হলেও আন্তর্জাতিক বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) গত মাসে এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত সাত বছরে বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর সমপরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে বিশ্বে। জিএফও এবং ডব্লিউআরআই সুনির্দিষ্ট করে বলেছে, বনভূমি উজাড় হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশে চট্টগ্রাম সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ২০১০ সালে যেখানে দেশের মোট বৃক্ষসম্পদের ৬০ শতাংশ ছিল চট্টগ্রামে সেখানে সাত বছরে তা কমে ১০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অপরদিকে কার্বন নিঃসরণে মানুষের ভূমিকা মানুষকে বড় ধরনের দুর্যোগের মুখে ফেলে দিয়েছে। উন্নয়ন ও শিল্পায়নের অভিশাপ  গোটা বিশ্বাসীকেই ভাবিয়ে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে সর্বগ্রাসীকরণ এবং কার্বন নিঃসরণে বিশ্বের শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমকে দায়ী করা হচ্ছে। এ থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যেখানে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া দরকার সেখানে বাংলাদেশে প্রতিবছর উজাড় হচ্ছে বনভূমি। বৃদ্ধি পাচ্ছে কার্বন নিঃসরণের হার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশেষ করে উষ্ণায়নের ধাক্কায় বেশি ভুগতে হবে দক্ষিণ এশিয়াকে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট খরা ও বন্যায় মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু থেকে কৃষিসহ সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কথাও বলছেন জলবায়ু বিশারদরা।
এদিকে বিশ্বব্যাংক তার এক প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশের ১৩ কোটি মানুষ জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশকে ১৬ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার দেশ হিসেবে ধরে নিয়ে তারা বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রচণ্ডতা অব্যাহত থাকলে এবং দ্রুত তা কমিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে। এখানকার মাথাপিছু জিডিপি ১৪.৪ শতাংশ কমে যাবে বলে জানাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। জিডিপির এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ১৪ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সম্প্রতি ‘সাউথ এশিয়াস হটস্পটস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ অবিলম্বে কমিয়ে আনা না গেলে দক্ষিণ এশিয়ার ছয় দেশের ৮০ কোটি মানুষকে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। যদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়ে তবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে সাড়ে ৩৭ কোটিতে আনা সম্ভব বলেও জানানো হয় ওই গবেষণা প্রতিবেদনে। তারা বলেছে, ক্ষতির শীর্ষে থাকবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে গড় তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় এবং বৃষ্টিপাতের বর্ষা ঋতুর আচরণ বদলে যাওয়ায় বাংলাদেশের নিচু ও উপকূলীয় এলাকা আরও বেশি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।


উষ্ণায়নের ঝুঁকি সব দেশেরই
ড. আইনুন নিশাত
পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষক
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশের অবস্থান অভিন্ন। পৃথিবীর সব দেশেরই এ ঝুঁকি রয়েছে। সব দেশের যে পরিণতি আমাদেরও তাই হবে। আলাদা করে কিছু হবে না। পৃথিবীজুড়েই এটা হচ্ছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছোট্ট ফোঁটার মতো একটি রাষ্ট্র। এখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে তাতে কিচ্ছু আসে যায় না।
অনেকেই মরুকরণ নিয়ে প্রশ্ন করেন। মরুকরণ বলতে মানুষের ব্যবহৃত জমির আনপ্রোডাক্টিভ অবস্থাকে বোঝায়। এর সঙ্গে জলবায়ুর কোনো সম্পর্ক নাই।


জলবায়ু সবসমই পরিবর্তন হচ্ছে
গওহার নঈম ওয়ারা
বাংলাদেশে বর্তমানে অস্বাভাবিক গরম পড়ছে, এটা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর এখন বর্ষাকালে (আষাঢ়-শ্রাবণ) মাসে বৃষ্টি হয় না, পরে আবার হয়। এটা মোটামুটি নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রত্যেক বছর হচ্ছে, এবারও এমনটা হচ্ছে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এ সময়ে গরমের দরকারও আছে। কারণ, এটা বিভিন্ন ফল পাকার মৌসুম। এ ধরনের গরম অস্বাভাবিক নয়। শহরে বেশি গরম লাগে কারণ আমাদের আলো-বাতাস আসার জায়গা নেই; বসবাসের জায়গা কম, অল্প জায়গায় অনেক বেশি মানুষ বসবাস করে। এসব কারণে আমাদের হয়তো গরম বেশি লাগে বলে আমরা অনুভব করি। এমন নয় যে, হাজার বছরে এরকম হয়নি বা পাঁচশ বছরে হয়নি। দুই বছরের মধ্যেই হয়েছে। এটা নিয়ে আমার মনে হয় না, আশঙ্কার কোনো কারণ আছে। গাছ সবসময় আমাদের দরকার। গাছরক্ষা করা বেশি জরুরি। বর্তমান সরকারের কর্মসূচি হচ্ছে, ত্রিশ লাখ গাছ লাগানো হবে। এ ত্রিশ লাখ গাছ রক্ষা করা হবে এটাও বলা উচিত। আগে খোলা জায়গা ছিল, বড় গাছ ছিল, মানুষ গাছের নিচে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছে। সেটা এখন নেই। জলবায়ু সতত পরিবর্তনশীল। হাজার বছর যে জলবায়ু ছিল, এখন তা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারি। পরিবর্তন হচ্ছে বলে হা-হুতাশ করে লাভ নেই। জলবায়ু সবসময়ই পরিবর্তন হচ্ছে। আদম (আ.)-এর সময় যে জলবায়ু ছিল এখন তো তা নেই। মানুষ খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এ প্রক্রিয়া আমাদের ত্বরান্বিত করতে হবে। যাতে আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি। এটাই হচ্ছে আসল। খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে গরম বেশি লাগবে। আমরা যখন বাড়িঘর বানাচ্ছি, পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখেই বানাচ্ছি।

 
Electronic Paper