শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর
বছরে জব্দ হাজার কোটি টাকার সম্পদ
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০১৮
বিগত তিন অর্থবছরে বিদেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি ও চোরাইপথে আনা ৪ হাজার ১৮৭ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকারের পণ্য আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর মধ্যে স্বর্ণ উদ্ধার করেছে ৮৫৮ দশমিক ৩২ কেজি। এ হিসাবে প্রতিবছর গড়ে এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করছে সংস্থাটি।
সংস্থার হিসেবে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ২৫৫ দশমিক ৬৭ কোটি টাকা, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ৩০ দশমিক ৯২ কোটা টাকা ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৯৬৫ দশমিক শূন্য ৭ কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্য আটক করে প্রতিষ্ঠানটি। গত তিন বছরে জব্দ করা সম্পদের মধ্যে স্বর্ণ, মোবাইল ফোন, বিদেশি মুদ্রা, মাদক ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার পণ্য আটক করেছে। কূটনৈতিক, কারনেট ও শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রায় শতাধিক গাড়ি আটক করেছে। এ ছাড়া অর্থ পাচারের অভিযোগে ক্রিসেন্ট লেদারের এক হাজার ১০৪ কোটি টাকা ও মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ১২০ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলাসহ বেশকিছু স্পর্শকাতর মামলা আমরা তদন্ত করছে। এ ছাড়াও চলতি বছরের চার মাসে (মার্চ-জুন) পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২০০ কোটি টাকার পণ্য আটক করেছে।
সূত্র জানায়, প্রায় শত কোটি টাকার শতাধিক গাড়ি আটক করা হয়। সর্বশেষ ৪ জুলাই উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি বিশেষ সুবিধায় আমদানি করা ১১টি বিলাসবহুল টয়োটা প্রাডো ও মিৎসুবিসি পাজারো আটক করা হয়। এসব গাড়ির মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ৫ জুলাই চোরাচালানের মাধ্যমে আমদানি করা প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বিলাসবহুল টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার আটক করা হয়। এ ছাড়া পোরশে, মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, লেক্সাস, নিসান, মিৎসুবিসি, জাগুয়ার ব্র্যান্ড, মারুতি সুজুকি, রোলস রয়েস, টয়োটা সিডান, রেভ, প্রিমিও এবং এলিয়ন ব্র্যান্ডের প্রায় শতাধিক গাড়ি আটক করা হয়। এর মধ্যে কারনেট সুবিধার অপব্যবহার করা ৫০ কোটি টাকার ২২টি, কূটনৈতিক সুবিধার অপব্যবহার করা প্রায় ২০ কোটি টাকার ২২টি এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা প্রায় ৪০ কোটি টাকার ৩৮টি গাড়ি আটক করা হয়। এসব গাড়ির মধ্যে বিশ্বব্যাংকের চারটি, ইউএনডিপির একটি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার দুটি, উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের একটি ও মিসরীয় দূতাবাসের একটি, ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের একটি, আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের একটি মার্সিডিজ এবং মডেল জাকিয়া মুনের ব্যবহার করা একটি পোরশে ব্র্যান্ডের গাড়ি আটক করা হয়। এ ছাড়া শতাধিক গাড়ি নজরদারিতে রয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত তিন বছরে শুল্ক গোয়েন্দা প্রায় ৯০৬ কেজি স্বর্ণ আটক করেছে, যার মূল্য প্রায় ৪৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে আপন জুয়েলার্স থেকে অবৈধপথে আমদানি করা প্রায় ৫০৩ দশমিক ৮২ কেজি বা সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণ আটক করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া সাড়ে সাত কোটি টাকার প্রায় ১৫ হাজার মোবাইল ফোন, প্রায় ৬৩ কোটি টাকার সিগারেট, প্রায় ১৮ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা, কোটি টাকার মাদকদ্রব্য এবং প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মিথ্যা ঘোষণার পণ্য আটক করা হয়। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় ৫১৩ কোটি টাকার মামলা করা হয়।
এ ছাড়াও ভারতে পাচারের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেন সন্দেহে সূর্যমুখী তেলের একটি কন্টেইনার আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা। কন্টেইনারে ১০৭টি ড্রামের মধ্যে ১৮৫ কেজি ওজনের একটি ড্রামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কোকেন পাওয়া যায়। পরে ল্যাব টেস্টে সব ড্রামে মাদক পাওয়া যায়। এ ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া রেইনট্রি হোটেল থেকে মাদক উদ্ধার, রাজধানীর হোটেলে মরণনেশা সিসার বিষয়ে পদক্ষেপ, মানবশরীরে স্বর্ণ বহন বা স্বর্ণমানব আবিষ্কার, মুসা বিন শমসেরের অর্থ পাচার, পরিবেশ বিনষ্টকারী পণ্য আটক, নজল আইফোন তৈরির কারখানার সন্ধানসহ তিন বছরে সব খাতে বিচরণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৫২ কেজি স্বর্ণ, প্রায় চার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা, ১৩ কোটি টাকার সিগারেট, তিন কোটি টাকার মোবাইল, প্রায় আড়াই কোটি টাকার ওষুধ এবং প্রায় ৩৫ কোটি টাকার গাড়ি আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্ডেড পণ্য থেকে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাসহ হুন্ডি ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। কিছু গাড়ি আটক ও কিছু নজরদারিতে রয়েছে। ক্রিসেন্ট লেদারের এক হাজার ১০৪ কোটি টাকা ও মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ১২০ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলাসহ বেশকিছু স্পর্শকাতর মামলা আমরা তদন্ত করছি। উত্তরা ক্লাব থেকে রাজস্ব ফাঁকির প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বোতল মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। সব অভিজাত ক্লাবের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। আমরা রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছি এবং ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে আমরা কাজ করছি।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য রেজাউল হাসান খোলা কাগজকে বলেন, সময়ের সঙ্গে অপরাধপ্রবণতা ও অপরাধের কৌশল পাল্টে যাচ্ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও নিত্যনতুন কৌশল আয়ত্ত করতে হচ্ছে। কাস্টমস গোয়েন্দাদের চৌকস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করার অধিকতর যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে। ফলে অপরাধীরা যতই কৌশল বদলায় তাদের আমাদের গোয়েন্দা জালে ধরা দিতেই হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু শুল্ক ফাঁকি রোধ ও প্রতিরোধই নয়, স্বর্ণ, মুদ্রা, মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্রসহ যে কোনো ধরনের চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। চোরাচালান এবং অন্য কাস্টমস অপরাধ ও জালিয়াতি প্রতিরোধ, বাণিজ্যিক জালিয়াতি, বাণিজ্য-সংক্রান্ত মানি লন্ডারিং এবং অন্য কাস্টমস আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও অধিদপ্তর তদন্ত করে।