ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এখনো রাজপুত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০১৮

রূপকথার সঙ্গে বাঙালি চৈতন্যের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। আমাদের ভাবনাজুড়ে রাজপুত্ররা ফিরে আসেন বারবার। দৈব-দুর্বিপাকে আমাদের প্রত্যাশা থাকে একজন রাজপুত্র ডালিমকুমারের। চকিত চমকে যিনি আসবেন, দেখবেন, জয় করবেন।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২) বাংলাদেশের সাহিত্যের সে রকম এক অপ্রতিদ্ব›দ্বী রাজপুত্র। জীবিত অবস্থায় যার জনপ্রিয়তা রূপকথাকেও হার মানিয়েছিল। ছয় বছর আগে এরকম শ্রাবণের একদিনে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে ছয় বছর। এ কয়বছরেও তাকে পেরিয়ে যাওয়া কিংবা তার সমকক্ষ কেউ আসেননি বাংলা সাহিত্যে। বছরজুড়ে কিংবা বইমেলায় এখনো বেস্ট সেলার তার সৃষ্টিকর্মগুলো। আর নাটক, চলচ্চিত্র ও গীতিকবিতায় এখনো তিনি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা সাহিত্যে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হুমায়ূন আহমেদের আগমন। সময়টা তখন ১৯৭২, বাংলাদেশের জন্মের সবে একবছর। রসায়ন শাস্ত্রের ছাত্র হুমায়ূন লিখলেন তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। বলা যায় একেবারে ঘা দিলেন বিকাশোন্মুখ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চৈতন্যকে। তারা এক ঘোর লাগা গদ্যের সঙ্গে পরিচিত হলেন, যেখানে চারপাশের পরিচিত বাস্তবতাগুলো মিলেমিশে একাকার। সেই যে পাঠক হুমায়ূন ঘোরের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন, সে সম্পর্কও আজও অমলিন। হুমায়ূন আহমেদও সেই জাদুকর যিনি তার ঝোলার ভেতর থেকে একে একে বের করেছেন তার সৃষ্টিশীল রূপকথাগুলো। উপন্যাস, নভেলা, ছোটগল্প, কল্পবিজ্ঞান, নাটক, গান, চলচ্চিত্র নির্মাণ সবক্ষেত্রেই পৌঁছে যান সাধারণের মণিকোঠায়।   
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজদের একজন যিনি সাহিত্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডল বা গুটিকয়েক বিদ্বৎজনের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন একেবারে সাধারণ্যে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ, আনন্দ, স্বপ্ন, কল্পনা- এ সব অনুভূতিকে একেবারে হালকা ঢঙে আনলেন কথাসাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে। হালকা ঢং হলেও তাতে মেশানো গভীর সংবেদনা। এটাই হুমায়ূনের জাদু। এ দিয়েই তিনি হাসতে হাসতে অশ্রুসজল করে তোলেন তার পাঠক-দর্শকদের। এই জাদুকরী ক্ষমতা দিয়েন হুমায়ূন আহমেদ কয়েক প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশে তৈরি করেছেন পাঠক। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়ার হাতেখড়ি হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়ে হয়নি, গত কয়েক দশকে এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তথ্য-প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্তমান জমানায় যখন ঢালাওভাবে অভিযোগ ওঠে কিশোর-তরুণেরা বইবিমুখ হয়ে গড়ে উঠছে, তখন হুমায়ূন আহমেদের বই এখনো ভিন্ন বার্তা দেয়। এখনো বইমেলায় লাইন ধরে কিশোর তরুণরা হুমায়ূন আহমেদের বই কেনেন। আর তার বই-ই বছরের পর বছর থাকে সর্বোচ্চ বিক্রি তালিকায়।
জনপ্রিয়তা আর লেখার প্রাচুর্যতা হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের জীবনে। যত লিখেছেন ততই জনপ্রিয় হয়েছেন তিনি। তার এই জনপ্রিয়তার জন্য সমালোচনার মুখেও পড়েছেন অনেকের। কিন্তু এ সবের মাঝেই তিনি শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমণি, দেবী, নিশিথিনী, নিষাদ, বৃহণ্নলা,  জোছনা ও জননীর গল্প- এর মতো অনবদ্য সৃষ্টি রেখে গেছেন। তার উপন্যাসের হিমু কিংবা মিসির আলী চরিত্র বাঙালি চৈতন্যে রীতিমতো মিথ হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সৃষ্টিতেও উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন বয়ান। কথাসাহিত্যের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকেও তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শ করেন। কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি- এখনো বাংলা টেলিভিশন নাটকের সবচেয়ে জনপ্রিয়। তার সৃষ্ট বাকের ভাই চরিত্রের জন্য যেমন মিছিল, সমাবেশ হয়েছে আবার ৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি তার নাটকে রাজাকার শব্দটা ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত স্বাধীনতাবিরোধীদের সামাজিকভাবে খারিজ করে দেওয়ার সংস্কৃতি জনসমাজে ছড়িয়ে দিতে অবদান রেখেছেন।
কথাসাহিত্য দিয়ে যে জার্নি হুমায়ূন আহমেদ শুরু করেছিলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়ে সেটাকে আরও বহুদূর নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আটটি পুরস্কার লাভ করে। এরপর একে একে শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), দুই দুয়ারী (২০০০), শ্যামল ছায়া (২০০৪) ও ঘেটু পুত্র কমলা (২০১২) নির্মাণ করেন তিনি। ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।  
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের মণিকোঠায় ঠাঁই পাওয়ায় হুমায়ূনের জীবনের সেরা অর্জন। বাংলা সাহিত্যের এই রাজপুত্র আরও বহুকাল স্মরিত ও চর্চিত হবেন।   

 
Electronic Paper