বিজয় দিবস বরণে প্রস্তুত সারা দেশ
শফিক হাসান
🕐 ৯:৫৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯
একসাগর রক্তে অর্জিত বিজয়ের ৪৯তম বর্ষ আগামীকাল। বিজয় দিবসকে বরণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে জাতি। বীর শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবে দেশের মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছে; তাদের শ্রদ্ধা জানানো হবে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারা দেশে। বিজয় দিবস ঘিরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বিক্রি বেড়েছে জাতীয় পতাকার। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রাজধানীর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যে যুগান্তকারী বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিপাগল বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। নেতার নির্দেশমতো যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর মুখোমুখি। ২৫ মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলায় নিহত হন অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানিদের হাতে আটক হন বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
রণাঙ্গনে না পেলেও তার নির্দেশিত পন্থায় এগিয়ে চলে মুক্তির জন্য যুদ্ধ। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আসে স্বাধীনতা। মায়ের কোলে সব খোকা-খুকি না ফিরলেও ফেরে অমূল্য ধন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশে^র বুকে অভ্যুত্থান ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। অর্জিত হয় লাল সবুজের পতাকা। এ পতাকায় জড়িয়ে আছে অনেক আবেগ আর ভালোবাসা। বীরের শৌর্য, মায়ের শোকাশ্রু, বাবার আশীর্বাদ, বোনের স্নেহ-মমতা।
এদিনটিতে একদিকে মানুষ ভাসবে বিজয়ে আনন্দে, অন্যদিকে মুষড়ে পড়বে স্বজন হারানোর বেদনায়। এ আনন্দ, এ বেদনা মিলেমিশে সৃষ্টি করে অন্য ইতিহাসের। মিশ্র অনুভূতি। একই দিনে আনন্দ, আবার আনন্দের দিনটাই শোকের উপলক্ষ এমন ব্যতিক্রমী আবেগ ধারণ ও লালন করা বাংলাদেশিদের পক্ষেই সম্ভব! দিনটি উপলক্ষে রাজধানীজুড়ে নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ সবাই তৎপর। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধেও নেওয়া হয়েছে সংস্কারমূলক কার্যক্রম। ১০৮ হেক্টর জমির ওপর নির্মিত স্মৃতিসৌধটির সৌন্দর্যবর্ধনে গত একমাস ধরে গণপূর্ত বিভাগের প্রায় একশ’ শ্রমিক কাজ করছেন। নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের কাজের সুবিধার্থে গত ১২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্মৃতিসৌধে দর্শনার্থীদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মূল স্মৃতিসৌধসহ গোটা প্রাঙ্গণ ঘষে-মেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে। রং তুলির আঁচড়ে রাঙানো হচ্ছে সৌধের পাদদেশেসহ পায়ে চলার রাস্তা। লাল-সবুজের সমারোহে সাজানো হচ্ছে ফুলের বাগানগুলো। ছোট্ট গাছের সারিতে তৈরি করা হচ্ছে লাল-সবুজের পতাকা। এ ছাড়া চলছে স্মৃতিসৌধের বাইরে ভেতরে আলোকসজ্জার কাজও। নিরাপত্তার জন্য এবার স্মৃতিসৌধ এলাকার ৩২টি পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও। সমানভাবে চলছে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ও সংস্থার মহড়াও।
বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রটোকল অনুযায়ী সরকার ও প্রশাসনের অন্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। পরে সর্বস্তরের জনতার জন্য খুলে দেওয়া হবে স্মৃতিসৌধ।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকেই স্মৃতিসৌধ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দু’পাশ ও ওভার ব্রিজসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি বসানো হয়েছে বাড়তি পুলিশি চেকপোস্ট। নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে পর্যাপ্ত পুলিশ। যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামাল দিতে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করবে বলে জানা যায়।
সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই স্মৃতিসৌধের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে। এ বছর সৌধকে অন্যরকম করে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এবারের বিজয় দিবস উদযাপন নানাভাবেই ব্যতিক্রম ও গুরুত্ববহ। ২০২০ সালে উদযাপিত হবে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারপর আসবে বিজয়ের ৫০তম বর্ষ। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অর্ধশতাব্দীকেও জাতি জমকালোভাবে পালন করবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এ উপলক্ষেও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শাণিত করতে নিয়েছেন যুগান্তকারী উদ্যোগ। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মানবতাবিরোধীদের বিচার হয়েছে। এসবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এ বার্তাই দিয়েছেন- অপরাধ করলে ক্ষমা নেই। আগামীর পরিকল্পনা ও স্বপ্নের হাত ধরে বাঙালি জাতি একদিন পৌঁছে যাবে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে, বাস্তবায়িত হবে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা।
দেশব্যাপী নিরাপত্তা বলয়
বাংলার গৌরবান্বিত অর্জন মহান বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে বিজয় উল্লাসে মাতবে পুরো জাতি। এ বিষয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স ও স^রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। কোনো ধরনের থ্রেট বা হুমকি না থাকলেও সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ঢেলে সাজানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পোশাকে ও সাদা পোশাকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও থাকছে বাড়তি নজরদারি।
পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি ঢাকাসহ সারা দেশ থাকবে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা এড়াতে প্রস্তুত থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি থাকবে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। তা ছাড়া নগরীর বিশেষ স্থাপনাসহ কিছু এলাকায় থাকবে বিশেষ নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা। নগরের আবাসিক-অনাবাসিক হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতেও বিশেষ নজরদারি থাকবে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, ভিআইপি ও সাধারণ মানুষের আগমনকে ঘিরে সেখানে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। একই সঙ্গে সাভার ও আশুলিয়ায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কসহ জাতীয় স্মৃতিসৌধমুখী সড়কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। পুরো স্মৃতিসৌধ এলাকাকে আনা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার ও সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায়। যেসব স্থানে বিজয়ের অনুষ্ঠান হবে সেখানেও থাকবে নিরাপত্তা বলয়। এ ছাড়াও বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করবেন।
এ বিষয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, বিজয় দিবস বাঙালি জাতির একটি বিশেষ দিন। এ দিনটি যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের সব নাগরিক নিশ্চিন্তে পালন করতে পারেন তার জন্য যা যা প্রয়োজন পুলিশের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সব নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। পোশাকে ও সাদা পোশাকে একাধিক টিম কাজ করবে বলেও জানান তিনি। তা ছাড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক স্তরের নিরাপত্তার বলয়ে দেশবাসী বিজয় উৎসব পালন করবে বলেও জানান তিনি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের হুমকি নেই।
পুলিশের পাশাপাশি র্যাব অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে থাকবে বলে জানিয়েছে র্যাব। র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল মো. সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থা এড়াতে সারা দেশেই র্যাবের টহলসহ থাকবে অসংখ্য চেকপোস্ট। তা ছাড়া নগরে স্পেশাল ভ্রাম্যমাণ টিম থাকবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে নেওয়া হয়েছে নজরদারি। জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলার কোনো ধরনের হুমকি নেই। তবে সবকিছু মাথায় রেখে র্যাব সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।