রায়ের দিকে তাকিয়ে রোহিঙ্গারা
আইসিজের শুনানি শেষ
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
🕐 ১:০১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুনানি শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার শেষ দিনের শুনানিতে প্রথমে মামলার বাদী গাম্বিয়া ও পরে মিয়ানমার তাদের স্ব স্ব যুক্তি তুলে ধরে। তবে শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত কি আসছে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
রাখাইনে নির্যাতন ও গণহত্যার ন্যায়বিচার হবে কিনা তা নিয়েই যত উদ্বেগ ও চিন্তা। রাহিঙ্গাদের অভিযোগ, দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি’র কারণেই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আজ শরণার্থী।
আইসিজের শুনানি নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেক আগ্রহ। তারা মনে করছেন, ন্যায় বিচার পেলে তাদের শরণার্থী জীবনের অবসান ঘটবে এবং তারা মাতৃভূমিতে ফিরতে পারবেন। শুনানিতে এই গণহত্যার বিষয়টিকে ঢাকতে পারেনি মিয়ানমার। গাম্বিয়া গণহত্যার স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করেছে। বেকায়দায় পড়ে মিয়ানমার চেষ্টা করছে যাতে বিষয়টি গণহত্যার আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় না পড়ে।
কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎ না থাকায় বেশির ভাগ রোহিঙ্গা খবর জানতে মোবাইল ফোনসেট ও রেডিও ব্যবহার করছেন। তারা জানান, তারা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছেন। এ সময় জাদিমুরা এলাকার এক চায়ের দোকানে বসে হেগের খবর জানার চেষ্টা করছিলেন মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে আসা মোহাম্মদ করিম (৭০)। তিনি হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই-ব্লকের বাসিন্দা।
আইসিজের শুনানি নিয়ে মোহাম্মদ করিম নামের একজন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বলেন, রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিচার শুরু হয়েছে। এর জন্য গাম্বিয়া ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেসব দেশ সহায়তা করেছে তাদের ধন্যবাদ। আমরা বাংলাদেশে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমাদের ভবিষ্যৎ গন্তব্য কোথায়, তা আমরা জানি না। দিন দিন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে, এখনই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার।
এ সময় বদি আলম (৬৮) নাম জানিয়ে অপর এক রোহিঙ্গা সদস্য বলেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি যখন গৃহবন্দি ছিলেন তখন রোহিঙ্গারাও তার মুক্তি আন্দোলনে যুক্ত হয়। তবে মুক্ত হওয়ার পর সু চি রোহিঙ্গাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। আন্তর্জাতিক আদালতেও সু চি মিথ্যাচার করেছেন। এটিই তার আসল চেহারা। সু চির কারণেই রোহিঙ্গারা এখন শরণার্থী হয়েছে। কিন্তু আমরা শরণার্থী হয়ে থাকতে চাই না। নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে আমরা দেশে ফিরতে প্রস্তত।
মিয়ানমারের মংডু শহরের বলিবাজার এলাকা থেকে চার সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন সাবেকুন নাহার (৩০)। আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে। দুই বছর আগে মিয়ানমারের সেনারা হত্যা করেছে তার স্বামীকে। সন্তানদের নিয়ে আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে- এ নিয়েই তার যত চিন্তা। সাবেকুন নাহারের মতো মিয়ানমারের দক্ষিণ ধুনছে এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছেন কুলসুমা বেগম। যার কোলে দেড় বছরের এক শিশু। তিনি জানান, তার রয়েছে ৮ সন্তান। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। কুলসুমা বলেন, তিন বছর ধরে প্রার্থনা করছি যাতে নিজেদের অধিকার নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারি। তা না হলে এভাবে (শরণার্থী হয়ে) বেঁচে থাকা সম্ভব না।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার ঘুমধুম শূন্য রেখা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, রাখাইনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংসতার গুরুতর যেসব অভিযোগ উঠেছে, শুনানিতে মিয়ানমার সেগুলো অস্বীকার করার চেষ্টা করেনি। এ ছাড়া ২০১৭ সালে নির্মূল অভিযান শুরুর পর গণহারে রোহিঙ্গাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করার চেষ্টা করেনি। এতেই বোঝা যায়, তারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত। বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (আইএফআরসি) প্রতিনিধি দল এসেছিল। এ সময় নাগরিকত্ব ছাড়া অন্যসব দাবি মেনে নিলে রোহিঙ্গারা ফিরবে কিনা- এমন প্রশ্নে, নাগরিকত্বের অধিকার ও নিরাপত্তা পেলেই কেবল সবাই ফিরবে বলে জানানো হয়েছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা মুঠোফোনে জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে বাংলাদেশ বহুমুখী সংকটের মধ্যে পড়বে। তাই দ্রুত এর সমাধান দরকার।
সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা প্রসঙ্গত, গত ১১ নভেম্বর ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মামলাটি করে। গাম্বিয়াও গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর অল্প সময়ের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।
এর আগে থেকে এ দেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের প্রায় ৩৪টি শিবিরে বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাস করছে।