উদ্বেগ বাড়বে বাংলাদেশের
ভারতে নাগরিকত্ব বিল চূড়ান্ত আইনে পরিণত
তুষার রায়
🕐 ১১:০২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যেই শুক্রবার বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে (সিএবি) স্বাক্ষর করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। ফলে এটি এখন চূড়ান্ত আইনে পরিণত হলো। এদিকে এ আইনের বিরুদ্ধে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুলিশের গুলিতে পাঁচ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। বিরোধী দলগুলো বিজেপি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নাগরিকত্ব বিল ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) জের ধরে ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপড়েন সৃষ্টি হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পূর্বনির্ধারিত দিল্লি সফর হঠাৎ করেই স্থগিত করেন। তখনই বন্ধুপ্রতীম দুদেশের সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়।
তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওই সফর বাতিলের সঙ্গে সিএবি বা এনআরসির কোনো সম্পর্ক নেই। এরমধ্যে ভারত হঠাৎ করেই সিলেট সীমান্তের তামাবিল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশিদের প্রবেশ স্থগিত করেছে। এছাড়া মহারাষ্ট্রে গ্রেফতার হয়েছেন সাত বাংলাদেশি।
এসব ঘটনায় উভয় দেশের সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা বাড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই দুদেশের বাসিন্দাদের আত্মীয়তা, আসা-যাওয়া, বসবাসের বিষয়টি জড়িত। অতীতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া মুসলিমরা এ আইনের আওতায় বিতাড়িত হওয়ার শঙ্কায় থাকবেন। আবার বাংলাদেশ থেকে সে দেশে যাওয়া হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন। হতাশা এবং ভয়ে থাকবেন বিপুলসংখ্যক মুসলিম। ফলে সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বহু মুসলিম বাসিন্দা বাংলাদেশে পাড়ি দিতে পারেন বলে আশঙ্কা।
কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, এই পরিস্থিতি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উত্তাপ ছড়াবে। বাংলাদেশে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে। ওপারে সাম্প্রদায়িকতা গুরুত্ব পেলে বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বসে থাকবে না। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, এতে বন্ধুপ্রতীম দুই সরকারের মধ্যে মতভেদ ও দুরত্বও বাড়তে পারে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টানদের সিএবি আইনের আওতায় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ভারতের বিরোধীদলগুলো বিলটিকে ‘মুসলিমবিরোধী’ আখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে, মুসলমানদের সুরক্ষার প্রশ্ন উপেক্ষিত থাকায় আইনটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে হেয় করেছে।
আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে এটি বাতিলের দাবিতে তুমুল বিক্ষোভ চলছে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার আসামে বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। কারফিউ উপেক্ষা করে কয়েকটি স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশের গুলিতে সেখানে নিহত হয়েছে ৫ বিক্ষোভকারী। পাশের রাজ্য মেঘালয়ও দুই দিন ধরে বিক্ষোভে অচল। শিলংয়ে জারি করা হয়েছে কারফিউ। ত্রিপুরা রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিস বন্ধ রয়েছে। কারফিউ, সেনা, পুলিশ আর আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই ওই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল ও কয়েকজন মন্ত্রীর বাড়িতে হামলার চেষ্টা হয়েছে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
এদিকে মেঘালয়ের শিলংয়ে বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুরের ফলে শিলং শহরের কোথাও কোথাও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। সেখানে জারি হয়েছে নৈশ কারফিউ। বিক্ষোভ চলছে উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য মণিপুরেও।
বিক্ষোভকারীরা বলছে, এই বিলের মাধ্যমে এসব রাজ্যে বিদেশি শরণার্থীর ঢল নামবে। ফলে রাজ্যের ভূমিপুত্ররা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।
গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই পূর্বনির্ধারিত ভারত সফর স্থগিত করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ান ওশান ডায়ালগে অংশ নিতে ভারত যাওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
হঠাৎ করে বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীর এভাবে সফরসূচিতে পরিবর্তন আনার বিষয়টিতে একটি বার্তা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে। তারা ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে : বিদেশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর আটকে বার্তা হাসিনার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সিএবি বিলটি যে ঢাকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে গভীর অসন্তোষ তৈরি করেছে তা এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে গেল। মোদি সরকারকে এতটা কড়া বার্তা দিতে সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার বলেন, সফর স্থগিত এবং নাগরিকত্ব বিল পাস হওয়া, দুটি আলাদা ঘটনা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, এনআরসি ও সিএবি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। ভারতের সঙ্গে কোনও বিষয়ে সমস্যা হলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আমার সমাধান করবো।
এই পরিস্থিতিতে সাত বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ।
এদিকে এ দুটি বিলের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বলেন, কোনো এনআরসি নয়, সিএবি নয়। আইন পাস হলেও রাজ্য সরকার তা কার্যকর করবে না। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমারিন্দর সিং ও কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও বলেছেন, এই বিল আটকাতে প্রয়োজনে আইন পাশ করা হবে। কংগ্রেসও এ বিলের তীব্র বিরোধিতা করছে।
তামাবিল দিয়ে ভারতে প্রবেশে বাধা:
সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশিদের ভারতে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না সে দেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি শান্ত হলে বাংলাদেশি পর্যটকরা প্রবেশ করতে পারবেন।
ভারত সফর স্থগিত করলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী:
বিক্ষোভের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ভারত সফর স্থগিত করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজো।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দু’পক্ষ (আবের) এ সফর পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা নিকট ভবিষ্যতে পারস্পরিক সুবিধা মতো দিনে হবে।
এদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, মুসলমানদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতের জন্য এটি একটি ভয়ঙ্কর খারাপ সিদ্ধান্ত। ভারত নিজের জন্যও বড় ক্ষতি করে ফেলছে। এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়।
বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, এ আইনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটবে। এই বিলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে অনেক। এই পরিস্থিতি অবশ্যই বাংলাদেশকে এড়িয়ে যাবে না। তার মানে ভারতের উত্তাপ বাংলাদেশে লাগবেই। এটা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উত্তাপ ছড়াবে। বাংলাদেশে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে। ওপারে সাম্প্রদায়িকতা গুরুত্ব পেলে বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীরা বসে থাকবে না।