পাটকল শ্রমিকদের নিঃসঙ্গ লড়াই
জাফর আহমদ
🕐 ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
মজুরি না পেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাটকল শ্রমিকরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক অনশন করছেন। তবে দাবিগুলোর ব্যাপারে এখনো গা করছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগ শ্রমিকদের। এরমধ্যে গতকাল খুলনায় একজন শ্রমিক মারাও গেছেন। জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা মজুরি পায় ২০১০ সালের মজুরি কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে। কিন্তু গত ১০ বছরে নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় জীবন নির্বাহের খরচ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। সেই সঙ্গে দুই মাসের মজুরি বাকি।
এ বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবহেলার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও সমাধান মিলছে না। খুলনা অঞ্চলে চলা এ আন্দোলন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য পাটকলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ জুট করপোরেশন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ পাটকলের শ্রমিক সংখ্যা এখন প্রায় ৫৭ হাজার।
এ শ্রমিকের মধ্যে রয়েছে নিয়মিত, অনিময়মিত ও বদলি। এর মধ্যে নয়টি পাটকলের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ১১ দফা দাবিতে অনশন কর্মসূচিতে আছেন। শ্রমিকদের ১১ দফার দাবির মধ্যে ২০১৫ সালের মজুরি কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে মজুরি প্রদান ও বকেয়া নয় থেকে ১০ সপ্তাহের মজুরি পরিশোধ প্রধান।
মঙ্গলবার থেকে শ্রমিকরা তাদের পোষ্যদের নিয়ে অনশনে আছেন। খোলা কাগজের খুলনা প্রতিনিধি জানান, অনশন চলাকালে গতকাল বৃহস্পতিবার একজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। খুলনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সন্ধ্যায় মারা যান তিনি। ওই শ্রমিকের নাম আ. সাত্তার। তিনি প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিক।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি মিলের মধ্যে ১০ মিলের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক আন্দোলনে আছেন।
এ সব মিল প্রায় সবই খুলনা যশোর অঞ্চলে। নরসিংদী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মিলের শ্রমিকরা আন্দোলনে আছেন। ধর্মঘটের সমর্থনে গতকালও শ্রমিকরা ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ন, আলিম এবং যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুটমিলের সামনে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
খুলনার আন্দোলনরত প্লাটিনাম জুটমিলের এক শ্রমিক জানান, তাদের মজুরি দেওয়া হয় ২০১০ সালের মজুরি কমিশনের ভিত্তিতে। ২০১০ সালের পর নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গত ১০ বছরে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। এব সব কথা চিন্তা করে সরকার মজুরি কমিশন গঠন করে। এবং প্রায় ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি করে মজুরি পুনর্নির্ধারণ হয়। যা ২০১৫ সাল থেকে কার্যকর হওয়া কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য খাতের শ্রমিক, সরকারী কর্মচারীরা ঠিকই বর্ধিত হারে বেতন পাচ্ছে। কিন্তু পাটকল শ্রমিকরা পাচ্ছেন ২০১০ সালের মজুরি কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী।
সেই সঙ্গে বকেয়া পড়ে আছে দুই থেকে তিন মাসের মজুরি। শ্রমিকরা জানান, সপ্তাহ ভিত্তিতে মজুরি দেওয়ায় সংসারের হিসাব নিকাশ ও অন্যান্য খরচ তারা সেভাবেই করে থাকেন। কিন্তু ৯ থেকে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত মজুরি বাকি। দোকানে বাকি আর সন্তান-সন্ততিদের খরচ চালাতে না পেরে তারা দিশাহারা। তারা বলেন, চাকরি করার পরও না খেয়ে থাকার চে’ অনশন করে মরে যাওয়া ভালো। খালি হাতে ঘরে ফিরবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
সর্বশেষ শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি বাবদ ১০০ কোটি টাকা দিলেও পুরো বকেয়া পরিশোধ করা যায়নি। তারপরও এই মজুরি দেওয়া হয়েছে ২০১০ সালের মজুরি কমিশনের ভিত্তিতে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিজেএমসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খোলা কাগজকে বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলন যৌক্তিক, তবে এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই।
শ্রমিকদের দাবির ন্যায্যতা স্বীকার করেছেন বিজেএমসির সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব শাহ মোহাম্মদ নাসিম।
তবে তিনি খোলা কাগজকে বলেন, অতিরিক্ত শ্রমিকের কারণে একই উৎপাদন করতে বেসরকারি জুটমিল যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, রাষ্ট্রায়ত্ত মিলকে গুনতে হয় তার দুই থেকে তিনগুণ। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অতিরিক্ত শ্রমিক বিদায় করা হলে এ ঘাটতি কমে আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।