শ্রমিক ‘হত্যা’র মিছিল
শফিক হাসান
🕐 ১০:৫০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০১৯
অগ্নিকাণ্ডে বেড়েই চলেছে শ্রমিক ‘হত্যা’র মিছিল। সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকার কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪-তে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ঢাকার রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অসংখ্য শ্রমিক। তখন শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত যে তেমন কিছুই হয়নি তা বোঝা যায় বিভিন্ন সময়ে কল-কারখানায় সংঘটিত দুর্ঘটনায়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এসব দুর্ঘটনার খবর দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে সহজেই। এতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে হয় বাংলাদেশকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বক্তৃতা-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ। সত্যিকার অর্থে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না কেউ। ন্যায্য মজুরি থেকে শুরু করে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিতে জোর দেওয়া হচ্ছে না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথম কিছুদিন তোড়জোড় চলে। তার সেই ‘উত্তেজনা’ মিলিয়ে যেতেও সময় লাগে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রেণিবৈষম্যের কারণেও জিইয়ে রাখা হয়েছে শ্রমিকদের সমস্যা। গরিব শ্রমিক পুড়ে মরলেও সেখানে শক্ত কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না কেউ। কারখানা মালিকসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে নেওয়া যায় না শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
কেরানীগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের প্রথম দিন একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও বৃহস্পতিবার মারা গেছে আরও ১৩ জন। দগ্ধ আরও ২১ জন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থাও ভালো নয় বলে চিকিৎসকরা জানান।
ওই কারখানার ধ্বংসস্তূপ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গত বুধবার এক যুবকের পোড়া দেহ উদ্ধার করেন। তার নাম জাকির হোসেন, বয়স আনুমানিক ২২ বছর। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন রাতে ও আজ সকালে মারা যান কারখানার কর্মী খালেক, সালাউদ্দিন, ইমরান, বাবলু, রায়হান, সুজন, জিনারুল, আলম, জাহাঙ্গীর, ফয়সাল, রাজ্জাক ও রায়হান।
আজ দুপুরে ঢামেক জরুরি বিভাগ সংলগ্ন মর্গের সামনে রুমা আহাজারি করেন। অক্ষমতা প্রকাশ করেন স্বামীকে বাঁচাতে না পারার। নিহত একজনের মরদেহ ঢামেক হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল। অনেকেই মর্গে মরদেহের মুখ দেখলেও কেউ চিনতে পারছিলেন না। অবশেষে গতকাল নিহতের বাবা গুলজার হোসেন ছেলেকে চিনতে পেরেছেন। তবে মুখ দেখে নয়, ছেলের বাম হাতের ব্রেসলেটটি দেখে মরদেহ শনাক্ত করেছেন তিনি। নিহতের নাম মাহবুব (২৫), বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। ৫ বছর যাবৎ এ কারখানায় মেশিন অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা গুলজার বলেন, ছেলে ফোন দিয়ে বলল, তার একটি ওষুধ বানাতে হবে। সেটার জন্য মধু দরকার। আমি মধু কিনে বাসায় রেখে দিয়েছিলাম। আগামীকাল (আজ শুক্রবার) আমার মিরপুরের বাসায় আসার কথা ছিল তার। এখন তো ছেলে আর কোনো দিন ফিরবে না।
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, বাকি ২১ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাদের মধ্যে শরীরের শতভাগ দগ্ধ রোগীও রয়েছে। ১১ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া হিজলতলা এলাকার প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানায় সংঘটিত দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট দেওয়া হবে আগামী ২ সপ্তাহের ভেতর। তদন্ত কমিটি গঠনের পরপরই আজ সকাল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরিদর্শন শুরু হয়।
এদিকে ঘটনায় নিহতদের পরিবারের আহাজারি ও আর্তনাদে চুনকুটিয়ার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম সাংবাদিকদের জানান, কেরানীগঞ্জের প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিকের কারখানার অনুমোদন ছিল না। ইতিপূর্বে কারখানাটিকে সতর্ক করে নোটিস দিলেও তা তারা কর্ণপাত করেনি।
আগুন লাগার প্রাথমিক কারণ হিসেবে এলপি গ্যাস লিকেজ হয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর উপ-পরিচালক (এ্যাম্বুলেন্স শাখা) আবুল হোসেন।
কারখানার পাশেই তিনতলা একটি বাড়ির মালিক মো. মাসুদ এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এ কারখানায় প্রায়ই আগুন লাগে। সে কারণে কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে চায় না।
আজ সকাল থেকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, মালিকের গাফিলতির কারণেই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তাই মালিকপক্ষই ক্ষতিপূরণ দেবে। এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কাজ করবে সরকার। গতকাল ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কেরানীগঞ্জের অগ্নিদগ্ধদের অবস্থা পরিদর্শনের পর তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানও হাসপাতালে দগ্ধদের দেখতে যান।
এদিকেঘটনার পর থেকে কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম পলাতক। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। কারখানাটিতে বিরিয়ানির প্লেট, প্যাকেট ও একবার ব্যবহার উপযোগী গ্লাস তৈরি করা হয়। কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০০। যে ইউনিটে আগুন লাগে, সেখানে কর্মরত ছিলেন ৮০ জন।
এর আগে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৭০ জন নিহত হন। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাম্পাকো প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হন ২৪ জন। আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসেও অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক প্রাণ হারায়।