ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হামলাকারীরা ছাত্রলীগেরই

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০১৮

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সমর্থক শিক্ষকদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগের ১৪ জন নেতাকর্মীকে চিহ্নিত করে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসব নেতাকর্মীর নামধাম ও ছবিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারক লিপি দিয়েছে তারা।

গতকাল দুপুর ১টার দিকে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য আখতারুজ্জামানের হাতে স্মারকলিপি তুলে দিয়ে অবিলম্বে ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
শিক্ষার্থীরা যেসব হামলাকারীকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছেন তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হল কমিটির নেতাকর্মীরা রয়েছেন। তারা হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির স্কুল ও ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদিন, উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ঢাবির চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী সুস্ময় দেওম, কবি জসিমউদ্দীন হল শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমাম হাসান, জহুরুল হক হলের কর্মী আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সূর্যসেন হল শাখার কর্মী ও উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ-২য় বর্ষের ছাত্র সিফাত উল্লাহ, এস এম হল শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সৌরভ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমান, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখার কর্মী ও ইংরেজি ৮ম ব্যাচের ছাত্র আনোয়ার হোসেন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাধারণ সম্পাদক ও চারুকলা অনুষদের ছাত্র মেহেদী হাসান সানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ রুম্মান হোসাইন, শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন রিফাত, অমর একুশে হল শাখার ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক ও ফলিত গণিতের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাতুল হাসান নাঈম, শহীদুল্লাহ হলের প্রচার সম্পাদক আবুল ফাত্তাহ তুহিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব হাসান বকুল।
স্মারকলিপি প্রদানের সময় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের পক্ষে আবু রাহয়ান খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় নানাভাবে ছাত্রদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন করা হয়েছে। গত ৩০ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এরপর ২ ও ১৫ জুলাইও হামলা চালানো হয়। সেই সময়ের ছবি থেকে আমরা ১৪ জনকে চিহ্নিত করেছি। এরা বিভিন্ন সময় নানাভাবে শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন করে আসছে। আমরা আশা করব বিশ্ববিদ্যালয় এদের বহিষ্কার করবে।
স্মারকলিপি গ্রহণ করে উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, যে নামগুলো পেয়েছি তা তদন্ত কমিটির হাতে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে নিয়মনীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশও দুষছেন ছাত্রলীগকে। গতকাল ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ’র ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কর্মসূচিসহ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্য কর্মসূচিতে হামলার জন্য ছাত্রলীগকেই দায়ী করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই, এরা ছাত্রলীগের কর্মী, এরা গুণ্ডাবাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ছাত্রলীগ তাদের ইতিহাস জানে না, তাদের ঐতিহ্য জানে না। তোফায়েল সাহেব (বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ) আর রাজ্জাক সাহেবের (প্রয়াত মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক) ছাত্রলীগ আর এ ছাত্রলীগ আপনি মেলাবেন? এটা সিম্পলি গুণ্ডাবাহিনী। যাদের শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই, তারা কোথায় পড়েছে, আমি জানি না। এ ধরনের আচরণ আমি আমার ২০ বছরের শিক্ষক জীবন ও সাংবাদিকতা জীবনে দেখি নাই।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা, অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দীন খান, সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনাসির কামালসহ আরও কয়েকজন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর কয়েক দফা হামলার জন্য ছাত্রলীগকেই দায়ী করে আসছিলেন আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীদের মারধরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরাও। যদিও ছাত্রলীগের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন দাবি করেছেন আন্দোলনকারীদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ থেকে সংঘাত হচ্ছে। তাতে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকলেও এতে সংগঠনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ওইদিন সাংবাদিকদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ফলে সংগঠনটির নামে কেউ কিছু করছে কিনা, তা তার জানা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে ড. সামিনা লুৎফা প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেন, আন্দোলনে যুক্তদের ‘বাম ঘরানার শিবির’, ‘জঙ্গির মতো’, ‘জামায়াত-শিবির’ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার, যারা নিপীড়ক তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হচ্ছে না। কেবল যারা নিপীড়িত, তাদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, বক্তব্য প্রদান করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিক থেকে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে এ শিক্ষকরা ১৯ জুলাই বেলা ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষকদের সংহতি সমাবেশ, ২৩ জুলাই কলাভবনের সামনে বটতলায় নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষক লাঞ্ছনার পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কাছে পত্র প্রেরণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আচার্যের কাছে স্মারকলিপি প্রদানের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

 

২৩ জুলাইয়ের আগেই শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচার হওয়া উচিত
ড. সামিনা লুৎফা, শিক্ষক, ঢাবি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একটা ন্যায়সংগত আন্দোলনের কর্মীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ২৩ জুলাইয়ের আগেই শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচার হওয়া উচিত।
যেভাবে চড়াও হয়েছে তা নজিরবিহীন। শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হলে আমরা বসে থাকতে পারি না। কিন্তু আমরা সংহতি প্রকাশ করতে গেলে আমাদের ওপরও চড়াও হয়েছে ছাত্রলীগ। আমাদের শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেছে। শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে। তার বিচার না করে উল্টো নিপীড়নের শিকার আন্দোলনের কর্মীদের জঙ্গি অপবাদ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষকরা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছি। ছাত্রদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মাঠে আছি। নতুন করে কিছু বলার নেই। সংবাদ সম্মেলনেই আমরা সব বলেছি। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষকরা সংহতি সমাবেশ করবে আর ২৩ জুলাই নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে। আশা করি, ২৩ জুলাই পর্যন্ত আমাদের মাঠে থাকতে হবে না। কারণ, এর আগেই তো শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচার হয়ে যাওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিচারবোধ থাকলে নিশ্চয় এর বিচার হওয়া উচিত।

 
Electronic Paper