ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মশা সন্ত্রাসে কাঁপছে বিশ্ব

স্যাটেলাইট দাগছে নাসা

মনোজ দে
🕐 ১০:২৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২১, ২০১৯

সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থা এই মুহূর্তে বিশ্বের সরকারগুলোর মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় কারণ। প্রায় প্রতিদিনই উগ্রবাদী বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের হামলায় রক্তাক্ত হচ্ছে বিশ্ব। সংঘাতে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের চিন্তার চেনা জগৎ। উগ্র মতাদর্শিক এই সন্ত্রাসের ডামাডোলের ভেতরেই সারাবিশ্বকে কাঁপাচ্ছে ক্ষুদে এক সন্ত্রাসী। বছরে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে সেই ক্ষুদে সন্ত্রাসী। বিশ্ব কাঁপানো সেই সন্ত্রাসীর নাম মশা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা দুনিয়ায় রাজত্ব করছে এখন ৩৫০০ প্রজাতির মশা। ছোট্ট এই পতঙ্গ নানা ধরনের অসুখ-বিসুখের বাহক। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ফাইলেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, জাপানি ইনকেফালাইটিসসহ শতাধিক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী এ মশা। বছরে বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মশাবাহিত অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে দাবি করেন অনেক গবেষক। কারও কারও দাবি, বছরে ৩০-৫০ কোটি মানুষ মশাবাহিত অসুখে আক্রান্ত। মশার কামড়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা এক কোটি!

যে সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রপন্থা এখন বিশ্বের পয়লা নাম্বার সমস্যা তাতে বছরে মারা যাচ্ছেন ২১ হাজার মানুষ। বিশ্বে বর্তমানে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। এক পরিসংখ্যান বলছে, বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের মধ্যে হৃৎপি-ের সমস্যায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান। এ সংখ্যা সাড়ে ১৭ লাখের মতো। আর ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন সাড়ে ৯ লাখ।

মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সন্ত্রাসী হামলা, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ক্যান্সারের চেয়ে অনেক বেশি। এক সময় বৃষ্টিপ্রবণ ও গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মশার উপদ্রব। ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন করতে এলে নাজেহাল হতে হয়েছে মশার আক্রমণে। ব্রিটিশ ভারতের এক সময়কার রাজধানী কলকাতায় মশা কোনো কোনো সময় এত বেড়ে যেত যে ক্ষুদ্র এই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে রীতিমতো কামান দাগা হতো। সেটা উনবিংশ শতকের ঘটনা। দুই শতাব্দী পরে একুশ শতকে এসে হাতেগোনা কয়েকটি অতি ঠাণ্ডার দেশছাড়া মশা সারা বিশ্বের জন্য রীতিমতো এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আর শুধু বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, লাইবেরিয়া নয়; যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জার্মানি সবাইকে ভাবাচ্ছে ক্ষুদ্র এই পতঙ্গ।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ও উপচেপড়া জনসংখ্যার নগরায়ণ কিংবা কীটনাশকপ্রতিরোধী হয়ে ওঠার কারণে মশার বংশ যেমন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন জায়গায়। ফলে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে মশাবাহিত রোগ-বালাই।

মশাবাহিত রোগের মধ্যে এক সময় আতঙ্কের নাম ছিল ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে সৃষ্ট ম্যালেরিয়া মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ায় এক সময় অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারের পর এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে এসেছিল। কিন্তু গত কয়েক দশকে আবার আতঙ্ক হয়ে ফিরে এসেছে ম্যালেরিয়া। ২০১৫ সালে এ রোগে প্রায় ৪ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

গত কয়েক বছরে দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভীষিকার নাম ডেঙ্গু। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসজনিত এ অসুখের জন্য দায়ী এডিস মশা। ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এ সময়ে লাখ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশেও এ বছর ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় এক লাখ মানুষ। মারা গেছেন দুই শতাধিক। এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু মোকাবেলার জন্য সরকারকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। কোনো ব্যাকরণ না মেনেই ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব সারা দেশের মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। ডেঙ্গু মোকাবেলার কৌশল শিখতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও কলকাতা সিটি করপোরেশনের অভিজ্ঞতা নেয় বাংলাদেশ। তবে ডেঙ্গু মোকাবেলার কৌশল রপ্ত করে প্রশংসিত কলকাতার বাসিন্দারা এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ বছরে এ সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

মশা নিধনে স্যাটেলাইট দাগছে নাসা
গ্রীষ্মপ্রধান দেশের এডিস মশা এখন হানা দিয়েছে আমেরিকাতেও। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ জার্সি বা সান ফ্রান্সিসকোকেও উপদ্রব হয়ে উঠেছে ক্ষুদ্র এই পতঙ্গ। শস্যবীজের মতো প্রাণশক্তিসম্পন্ন মশার ডিম উড়োজাহাজে কিংবা অন্যকোনো মাধ্যমে গিয়ে সেখানে বিস্তার লাভ করছে। বাড়ছে মশাবাহিত রোগবালাই। মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েক মাস আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বড় শহরে ড্রোন উড়িয়েছিল গুগল। এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে মশা দমনের ভার নিল খোদ নাসা, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার ল্যাবরেটরি। এদের হাতিয়ারটি ড্রোনের চেয়েও শক্তিধর। মশা মারতে কামান নয়, রীতিমতো স্যাটেলাইট দেগেছে নাসা। স্যাটেলাইট দিয়ে চালানো হবে তল্লাশি কোথায় কোথায় মশার প্রাদুর্ভাব। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ছোট ছোট দলও তৈরি করেছে তারা। থাকছে এয়ার ট্র্যাপিংয়ের ব্যবস্থাও। এককথায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পথে তারা দমন করতে নেমেছে মশা।

‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি)-র তথ্য অনুয়ায়ী, গত কয়েক দশকে মশার প্রকোপ বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিশেষ করে গরমের সময় এই মশার উৎপাত পৌঁছেছে চরমে। ২০০৪ সালে মশার প্রাদুর্ভাব যতটা ছিল, ২০১৬ পৌঁছে সেই প্রভাব বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। নাসা-ও মশা দমনের প্রকল্পটি প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে শুরু হয় বছর পাঁচেক আগেই। আসে বিপুল সাফল্য। সেই সফলতায় এবার এই প্রকল্পটিকে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে দেওয়ার সাহস জোগায় নাসাকে। শুধু ক্যালিফোর্নিয়া নয়, এবার যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যেখানে যেখানে মশা রয়েছে সেখানেই তল্লাশি চালাবে নাসার স্যাটেলাইট।

মশা দমনে স্যাটেলাইটের ভূমিকা কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্যাটেলাইট লক্ষ্য রাখবে কোথায় মশা জন্মানোর পরিবেশ-পরিস্থিতি রয়েছে। সেই তথ্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চলে যাবে মশা নিয়ন্ত্রক দলের কাছে। এ দলে থাকছেন পতঙ্গবিদ, বিজ্ঞানীসহ অনেকেই। তারা অকুস্থলে পৌঁছে মশার ডিম পাড়ার খবর, লার্ভা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা, মশার শরীরে কতটা জীবাণু আছে তা খতিয়ে দেখবে। তৈরি করবে জায়গাটির মানচিত্র, তুলে রাখবে ছবিও। যার সাহায্যে বোঝা যাবে ওই মশা কতটুকু ছড়িয়ে যেতে পারে, জায়গার অবস্থানই বা কী। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী শুরু হবে মশা নিধনযজ্ঞ।

 
Electronic Paper