ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এখনো আঁতকে ওঠে মানুষ

সেই ভয়াল সিডর দিবস

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:১১ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৫, ২০১৯

আজ সেই প্রলয়ঙ্করী ১৫ নভেম্বর, সিডর দিবস। ২০০৭ সালের এই দিনে ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাসের সঙ্গে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার পানি আঘাত হেনেছিল উপকূলীয় এলাকায়। এতে পানির চাপে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীপাড়ের বেড়িবাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৬৮ হাজার ৩৭৯টি ঘরবাড়ি। পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায় ৩৭ হাজার ৬৪ একর জমির ফসল।

সেদিন সিডর মূলত বেশি আঘাত হানে বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর জেলায়। তবে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয় বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায়। এখানে সাত শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু হয়েছিল। এদের মধ্যে উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নেই মারা যান ছয় শতাধিক। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন শিশু, নারী ও বৃদ্ধ। 

১২ বছর পরও দুঃসহ সেই দিনের কথা মনে করে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন অনেকে। হারানো স্বজনের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান কেউ কেউ। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ভয়াল স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলবাসীকে। সিডর আঘাতের একযুগ পরও ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোয় নির্মাণ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে চলতি বছর আবার বুলবুল আঘাত হানে। আগের ক্ষত এখনো না শুকালেও নতুন করে আবার ক্ষত জায়গা আঘাত করে বুলবুল। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় আবহাওয়া অফিস ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দিয়েছিল। এবারও বুলবুলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেয় আবহাওয়া অফিস। তবে বুলবুলে বাতাসের গতিবেগ ছিল সিডরের অর্ধেক। যে কারণে বেশি ক্ষতি না হলেও যা ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে ওঠা উপকূলের সাধারণ মানুষের জন্য খুবই কঠিন।

সিডরে বাগেরহাটের শরণখোলার পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বরগুনার পাথরঘাটায়। পাথরঘাটার হাড়িটানা এলাকার কৃষক হেমায়েত হাওলাদার বলেন, সিডরের সময় পরিস্থিতি এমন হয়েছিল মনে হচ্ছিল আমরা মারা যাব। কিন্তু আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন। সে বছর রাস্তাঘাট থেকে সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবার বুলবুলেও আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বেশি ক্ষতি হয়েছে ফসলের।

জানা গেছে, সিডর-আইলার মতো দুর্যোগের পরও বাগেরহাট, বরগুনায় দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ গড়ে উঠেনি। ফলে আতঙ্ক কাটেনি উপকূলবাসীর। দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হলেও অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে হতাশায় তারা।

সিডর, মহাসেন, আইলা ও রোয়ানুর আঘাতের কারণে বরগুনায় ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৫০০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ১৫০ কিলোমিটার। উপকূলে শত শত মানুষ, গবাদিপশু ও বন্যপ্রাণীর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। নিখোঁজ হয় বহু মানুষ। দুর্যোগের আগের দিনও যে জনপদ ছিল মানুষের কোলাহলে মুখরিত, প্রাণচাঞ্চল্য ছিল শিশু-কিশোরদের। মাঠজুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোনালি ধানের সমারোহ, পর দিনই সেই জনপদ পরিণত হয় মৃতের ভাগাড়ে। একযুগ পরও সেই স্মৃতি নিয়ে এখনো সেখানকার মানুষ বেঁচে আছেন। তাদের অধিকাংশই হারিয়েছেন স্বজন। সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়লেই এখনো আঁতকে ওঠেন তারা। উপকূলের মানুষের স্মৃতিতে এখনো ভেসে ওঠে শত শত মানুষের চিৎকার আর স্বজনদের আহাজারি।

পটুয়াখালী : ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখনো ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কেউ ঘর তুলতে এনজিওগুলোর দ্বারস্থ হয়ে ফের ঋণের জালে আটকা পড়ছে। সেই সুযোগে রমরমা ব্যবসা করছে এনজিওরা। এখনো ঝুঁকিমুক্ত নন উপকূলীয় চার কোটি মানুষ। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও জলোচ্ছ্বাস ২২টি জেলায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা যান। ক্ষয়ক্ষতি হয় হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ফসল, গাছপালা, বাড়িঘরসহ অন্যান্য সম্পদের। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ধারণা করা হয়। গলাচিপার শতাধিক চরের মধ্যে ৩৭টি চরে জনবসিত রয়েছে।

এর মধ্যে ইউনিয়ন ৭টি চরকাজল, চরবিশ্বাস, চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, ছোটবাইশদিয়া, বড়বাইশদিয়া ও চালিতাবুনিয়ায় লক্ষাধিক মানুষ বাস করেন। সিডরে প্রতিটি চরই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। চরলতা, চরহেয়ার, চরগঙ্গা, চরহালিম, চরকাশেম, চরকানকুনিপাড়া, চরযমুনা, চরকারফারমা, চরলক্ষ্মী, চরআন্ডার শতকরা ৯৯ ভাগ ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উপজেলার চাষাবাদকৃত ৫১ হাজার হেক্টর জমির ৭০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যায়।

বাগেরহাট : বছর ঘুরে দিনটি এলেই গুমড়ে কাঁদে বাগেরহাটের শরণখোলাবাসী। ক্ষোভে-দুঃখে স্বজনহারাদের একটাই আক্ষেপ তখন যদি উঁচু এবং টেকসই বেড়িবাঁধ থাকত তাহলে তাদের আপন মানুষগুলোকে চোখের সামনে থেকে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হতো না। বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলার ৭৫টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌর এলাকার পুরোটাই চরম ক্ষতির শিকার হয়। জেলায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৪৮২টি পরিবারের ১২ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতির শিকার হন।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৬৩ হাজার ৬০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্তসহ ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মানুষ সহায়তা পেলেও এখনো অনেক মানুষ আগের মতো করে সুন্দর ঘর তুলতে পারেননি। কাটিয়ে উঠতে পারেননি সিডরের ক্ষতি। সিডরে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 
Electronic Paper