ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জোড়াতালিতেই চলছে রেল

কুন্তল দে
🕐 ১০:৩২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৪, ২০১৯

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দভাগ রেলস্টেশনে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়নের ভয়াবহ সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হওয়ার দুদিন পেরুতে না পেরুতেই আবার ট্রেন দুর্ঘটনা। এবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে আগুন ধরে যায় তিনটি বগিতে। যাত্রীরা জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।

মন্দভাগে ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে পাঁচটি কমিটি। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। এখন পর্যন্ত মোটা দাগে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে এগুচ্ছে তদন্ত। একটি পক্ষ বলছে, তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের চালক সিগন্যাল অমান্য করায় ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

অন্য পক্ষ বলছেন, রেল লাইনের পাশে নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ থাকায় সিগন্যাল দেখতে না পাওয়ায় এমন দুর্ঘটনা। তবে মন্দভাগসহ বেশ কয়েকটি রেলস্টেশনে সিগন্যাল ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে এমনটা জানিয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করার পাশাপাশি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কয়েকমাস আগেই জানিয়েছিলেন ট্রেন চালকেরা। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেনি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। বিশ্লেষকরা বলছেন, চালকের ভুল কিংবা বেপরোয়াপনা, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, রেলের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার খেসারতে অকালে ঝরে গেছে ১৬টি প্রাণ। চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন আরও অনেকে।

গতকাল উল্লাপাড়ার ট্রেন দুর্ঘটনার পর গঠন করা হয়েছে তিনটি তদন্ত কমিটি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সিগন্যাল সিস্টেমের ত্রুটির কারণে এ দুর্ঘটনা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘সিগ্যনালের যে অংশটি দিয়ে ট্রেনকে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যেতে সাহায্য করে, সেখানে কোনো ত্রুটি থাকতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা রিপোর্ট দিলে পুরোপুরি বলা যাবে।’

রেলপথ সবচেয়ে নিরাপদ আর সাশ্রয়ী যাতায়াত ব্যবস্থা বলে বিবেচিত হলেও জোড়াতালিতেই চলছে। টিকিটের জন্য হাহাকার, উপচেপড়া যাত্রীর ভিড়ের পরও বছরের পর বছর লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না রেল। ৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটার রেলপথের বেশির ভাগটাই ব্রিটিশ আমলে তৈরি। রেলসেতুগুলোর ৯০ শতাংশও নির্মাণ হয়েছে ব্রিটিশদের হাতেই। বেশির ভাগ রেলপথ ও সেতু শত বছরের পুরাতন হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণ। বাংলাদেশের ট্রেনগুলো গড়ে ৫০-৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে না চললেও দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায়শই।

রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলপথে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। ৯০ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে শুধু লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকায়। একই সঙ্গে লাইনে ভাঙা স্লিপার, ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেট না থাকাও এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। রেলে ব্রিটিশ আমলের রেলওয়ে ব্রিজ রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। এসব ব্রিজের স্লিপার জরাজীর্ণ, লাইনে নেই ক্লিপ-হুক, ফিশপ্লেটও।

জরাজীর্ণ রেললাইনে নাটের বদলে বাঁশ ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে গতি ৫ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা- এ রকম কিছু টোটকা ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে ট্রেন। অন্য সবক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন ঘটলেও রেলের ক্ষেত্রে এখনো ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়াল ব্যবস্থা রয়েছে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক ও লোকবলের ঘাটতিও প্রকট। আবার রেলে যে প্রকৃত আয় হওয়ার কথা দুর্নীতি-চুরির কারণে উল্টো গুনতে হয় লোকসান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ^ব্যাংক ও আইএমএফের চাপে ৮০ ও নব্বই দশকে রেল সংকোচনের যে নীতি নেওয়া হয়েছিল তার ফলেই পরিবেশ ও জনবান্ধব এই পরিবহন ব্যবস্থা ভঙ্গুর দশা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। জনবল ছাঁটাই, রেলপথ কমিয়ে আনাসহ রেল ধ্বংসের নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। রেলের যে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এর পেছনে রেল সংকোচনের নীতি। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেল সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেয়। এ সময়ে রেলপথে বড় বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু এ সব প্রকল্পেও দূরদর্শিতা ও পরিকল্পনা ঘাটতি থাকায় কার্যত ধুঁককে থাকা রেলের দশা আরও জরাজীর্ণ হয়েছে। নতুন রেলপথ নির্মাণ, নতুন নতুন ট্রেন আনা, রেলকোচের আমদানি এ সব খাতেই গেছে বিনিয়োগের সিংহভাগ। কিন্তু পুরাতন রেললাইন সংস্কার, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু পুনঃনির্মাণ, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়েছে সামান্য। ফলে রেলে বিনিয়োগের সুফল পাচ্ছে না জনগণ। আর রেলপথে অব্যবস্থাপনা প্রকট হওয়ায় নিয়মিতই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ অবস্থায় রেল নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনার পাশাপাশি রেল নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
রেল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো বড় কোনো দুর্ঘটনার ঘটার পরেই সবার টনক নড়ে। কিছুদিন সেই বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। গঠন করা হয় একের পর এক তদন্ত কমিটি। কিন্তু অধিকাংশ কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। আবার যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেগুলোর সুপারিশমালার বেশির ভাগই থাকে অবাস্তবায়িত। সম্প্রতি কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু ও লাইন সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এ নির্দেশের পরও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

সম্প্রতি রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদূরদর্শিতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জুন মাসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রেলওয়ের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় রেলওয়ে একটি ভঙ্গুর যাত্রীসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলওয়ের উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সংস্থাটি এখনো সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। বিশেষ করে জনবল সংকট, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দূরদর্শিতার অভাবে রেলওয়ের বিবর্ণ চিত্র দিনকে দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে।

বিএনপির শাসনামলে রেলওয়ের সংকোচননীতির সমালোচনার পাশাপাশি বর্তমান সরকারের মেয়াদেও এ খাতে অপরিকল্পিত বিনিয়োগের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে চীন থেকে ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয়েছিল আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতা কিংবা প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই। এর ফলে মাত্র সাড়ে চার বছরেই আমদানি করা এসব ডেমুর প্রায় সবই অচল হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে সাতটি।

রেলের ওয়ার্কশপগুলোর করুণ চিত্রের বর্ণনা উঠে আসে প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের কোচ বা বগিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে রেলের সার্বিক অব্যবস্থাপনা, আন্তরিকতার অভাব এবং সেবার নিম্নমানের চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন কিছু আমদানি করা ব্যতীত প্রায় সব বগি বা কোচ পুরনো ও জরাজীর্ণ। অথচ রেলের জন্য চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরে দুটি ওয়ার্কশপ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। রেলের কোনো যন্ত্রাংশ সেখানে এখন মেরামত হয় না। সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে রেলের নিম্নমানের যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, যা অল্প কিছুদিন পর আবার নষ্ট হয়ে যায়।

ওই প্রতিবেদনে, রেলের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি রেলের দুর্নীতি, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত করে রেলের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন এবং একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।

 
Electronic Paper