ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা
নিজস্ব প্রতিবেদক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
🕐 ১০:৫০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০১৯
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক যাত্রী। ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে ৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে, বরখাস্ত করা হয়েছে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের তিনজনকে। আর নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে সরকার এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেছে।
জানা গেছে, সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার মধ্যে ভয়াবহ এ সংঘর্ষ হয়। তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী ছিল। তূর্ণা নিশীথা সিগন্যাল অমান্য করায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় তূর্ণা নিশীথার একাধিক বগি উদয়ন এক্সপ্রেসের ওপর উঠে যায়।
আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশের ওসি শ্যামলকান্তি দাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আহতদের কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। মুন্না নামে ২০ বছর বয়সী এক তরুণকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নিহত ও আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশু রয়েছে। ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন সেখানে ছুটে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ১০ জনের মৃত্যু হয়। পরে বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ৬ জন মারা যান। দুর্ঘটনায় নিহত ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে সাতজনের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়, পাঁচজনের বাড়ি চাঁদপুরে। বাকি তিনজনের বাড়ি সিলেট, মৌলভীবাজার ও নোয়াখালী জেলায় বলে জানা গেছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন- হবিগঞ্জ শহরতলির বড় বহুলা গ্রামের আলমগীর আলমের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত (১২), আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা ও জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), বানিয়াচং উপজেলার তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়ার আড়াই বছরের মেয়ে আদিবা আক্তার সোহা ওরফে ছোঁয়ামণি ও মদনমুরত গ্রামের আল-আমিন (৩০), চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা গ্রামের পশ্চিম তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে রুবেল মিয়া তালুকদার (২৫), মিরাশী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (৩০) ও একই উপজেলার আহমদাবাদ গ্রামের পিয়ারা বেগম (৩২)।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার রাজারগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম রাজারগাঁও গ্রামের মজিবুর রহমান (৫০) ও তার স্ত্রী কুলসুমা বেগম (৪২), সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের উত্তর বালিয়া গ্রামের প্রবাসী বিল্লাল বেপারীর মেয়ে ও শহরের নাজিরপাড়া দেওয়ান বাড়ির মোহন দেওয়ানের স্ত্রী ফারজানা (১৮), হাইমচর উপজেলার কাকলী (২০) ও মরিয়ম (৪), সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রিপন মিয়া (২৫), নোয়াখালীর মাইজদির রবি হরিজন (২৩) ও মৌলভীবাজারের জাহেদা খাতুন (৩০)।
দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তিনটি ইউনিট এবং পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। স্থানীয় লোকজনও তাদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন। ঘটনার পর মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। এসময় রেলওয়ে সচিব মোহাম্মদ মোফাজ্জল করিম, জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, ৬০ বিজিবি সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান বলেন, সিলেট থেকে ছেড়ে উদয়ন এক্সপ্রেস যাচ্ছিল চট্টগ্রামে। আর তূর্ণা নিশীথা চট্টগ্রাম থেকে যাচ্ছিল ঢাকায়। তূর্ণা নিশীথার চালকের অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি আমরা। মিয়া জাহান বলেন, মন্দবাগে দুই ট্রেনের ক্রসিং হচ্ছিল। সিগন্যাল পেয়ে উদয়ন মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে প্রবেশ করছিল। ট্রেনের নয়টি বগি লুপ লাইনে চলে যাওয়ার পর দশম বগিতে হিট করে তূর্ণা নিশীথা। ওই ট্রেনের লোকোমাস্টার সিগন্যাল অমান্য করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক আহত যাত্রী বলেন, তাদের বগির অধিকাংশ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয় আর তিনি আসন থেকে ছিটকে পড়ে যান। পরে দেখি ট্রেন একবারে ছিন্নভিন্ন হইয়্যা গেছে। খালি চিৎকার আর চিৎকার মানুষের। হাসপাতালে ভর্তি আরেক কিশোর জানায়, মা, ভাই, দুই বোন আর নানিকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল তারা। দুর্ঘটনায় নানি আর এক বোন পায়ে আঘাত পেয়েছে। হট্টগোলের মধ্যে মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি। কুমিল্লা মেডিকেলে ভর্তি উদয়নের এক যাত্রী বলেন, তার বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে, সিলেট গিয়েছিলেন মাজার জিয়ারত করতে। ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়েছেন।
তিন জনকে বরখাস্ত
দুর্ঘটনার পর মঙ্গলবার সকালে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের লোকোমাস্টার বা চালক তাহের উদ্দিন, সহকারী লোকোমাস্টার অপু দে ও গার্ড আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে ৫টি কমিটি
এদিকে দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে অন্তত ৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এগুলো মধ্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিতু মরিয়মকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে তিনটি, রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
নিহতের পরিবারকে ১ লাখ করে ক্ষতিপূরণ
গতকাল রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আর আহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এদিকে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দুটি সরিয়ে ৮ ঘণ্টা পর লাইন আবার সচল করা হয়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে ট্রেন চলাচল আবার স্বাভাবিক হয়।
কুয়াশার কারণে লালবাতি দেখতে পাননি চালক
কুয়াশার কারণে লালবাতি সিগন্যাল আগেভাগে দেখতে না পাওয়ার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটি ৬০-৬৫ কিলোমিটার গতিতে চলছিল। ঘন কুয়াশার কারণে চালক লাল সংকেত সিগন্যাল দেখতে পাননি। তূর্ণা নিশীথার চালক যখন সংকেত দেখতে পান, তখন ইমার্জেন্সি ব্রেক করেন। ট্রেনের গতিবেগ ২০ কিলোমিটারে নেমে আসলেও পুরো গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। আমরা স্পিড রেকর্ডারও পরীক্ষা করে দেখেছি। ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পরও ঘন কুয়াশা দেখেছি আমি। তাই আমরা মনে করি, ঘন কুয়াশার কারণেই মূলত দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তবে মন্দনাগ রেল স্টেশনের মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরী বলছেন, আউটার ও হোম দু-জায়গাতেই তূর্ণাকে দাঁড়ানোর জন্য সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে পৃথক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনায় নিহতদের রুহের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। দুর্ঘটনায় আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার এক শোকবার্তায় বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন তাদের স্বজনদের মতো আমিও গভীরভাবে ব্যথিত, শোকাভিভূত ও উদ্বিগ্ন।