অপেক্ষায় নুসরাতের মা
চান সব আসামির ফাঁসি
নিজস্ব প্রতিবেদক ও ফেনী প্রতিনিধি
🕐 ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যামামলার রায় আজ বৃহস্পতিবার। রায় ঘোষণা করবেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ।
এ মামলায় অপরাধ প্রমাণ হয়েছে দাবি করে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ আসামিদের ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’ দাবি করেছেন রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। আর নুসরাতের স্বজনরাও আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেখতে চান।
নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আখতার গতকাল বুধবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি সব আসামির ফাঁসি চাই। আমার মেয়ে ১০ দিন সীমাহীন কষ্ট করেছে। এক টুকরো অক্ষত মাংস নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারেনি। সেই যন্ত্রণা যেন খুনিদেরও দেওয়া হয়। তাদের এমন শাস্তি হোক যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।’
গতকাল বুধবার বিকেলে সোনাগাজী পৌর এলাকার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের বাড়িতে তিনি এ আকুতির কথা জানান। মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ফেনী জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু বলেন, মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ আসামির সাক্ষ্যগ্রহণ এবং যুক্তিতর্ক গ্রহণ সম্পন্ন দেশের ইতিহাসে নেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন চাঞ্চল্যকর মামলার নিষ্পত্তি একটি বিরল ঘটনা। আমরা আশা করি সুবিচার পাব, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।
অন্যদিকে মামলায় ‘দুর্বল সাক্ষী ও বেশ কিছু অসঙ্গতি’ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে আসামিরা খালাস পাবেন বলে দাবি করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের অনুসারীরা। ৮ এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৪ জনসহ মোট ১২ জনের নামে সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে বলা হয় মামলায়। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় নুসরাতের। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।
নুসরাতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নুসরাতের মা শিরিন আখতার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা আর দিক-নির্দেশনা না থাকলে এত দ্রুত সময়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া সম্ভব হতো না। তিনি আমাদের পাশে ছিলেন বলেই আসামিদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের খেয়াল না করলে আমাদের অস্তিত্বও থাকত না। প্রধানমন্ত্রী সান্তনা দিয়েছিলেন, এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।
আসামিপক্ষ থেকে হুমকি-ধমকির ব্যাপারে নুসরাতের মা বলেন, আসামিরা হুমকি দিচ্ছে, তারা আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ফেলবে। ঘরে বাতি দেওয়ার মতো কোনো লোক থাকবে না। নুসরাতের কবর থেকে লাশ গায়েব করার হুমকিও দিয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শিরিন আখতার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ আমাদের পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, রায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত যেন এ নিরাপত্তা কার্যক্রম চালু থাকে।
মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, এ মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। আর এ দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে আর কোনো বোনকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন প্রাণ দিতে না হয়। আমি আশা করি এ মামলায় আমরা ন্যায় বিচার পাব।
আসামিদের গ্রেফতার ও তদন্তের পর গত ২৮ মে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেদিন অভিযোগপত্রসহ মামলার নথি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ৩০ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আসামিদের হাজির করা হলেও বিচারক সেদিন অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি না করে ১০ জুন শুনানির তারিখ ধার্য করেন। পরে ১০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন।
এ ১৬ আসামি হলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, আওয়ামী লীগ নেতা ও মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল। মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হলেও তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক শুনানির পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ২৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক মামুনুর রশিদ।
অন্যদিকে অধ্যক্ষের যৌন হয়রানির বিষয়ে নুসরাতের অভিযোগ গ্রহণের সময় তার ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনেরও বিচার চলছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে।