ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রিমান্ডে ভেঙে পড়েছেন সম্রাট, দিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৩:৩৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২১, ২০১৯

মাদক মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে থাকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ হলো আজ সোমবার। অসুস্থ দাবি করায় তাঁকে সাবধানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রিমান্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

রিমান্ডে শেষে আদালতে একটি অবহিতপত্র দাখিল করেছেন এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১ এর উপ-পরিদর্শক আব্দুল হালিম। এই অবহিতপত্রে তিনি লিখেছেন, রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন সম্রাট; যা তদন্তের স্বার্থে গোপন রাখা হচ্ছে এবং যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অবহিতপত্রে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, অস্ত্র মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখর চন্দ্র মল্লিক সম্রাটকে এখন রিমান্ডে পাবেন।

এর আগে, মাদক ও অস্ত্র মামলায় ৫ দিন করে গত ১৫ অক্টোবর সম্রাটকে মোট ১০ দিনের রিমান্ডে দেন ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালত। রমনা থানায় করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় সম্রাট ১০ দিন এবং তাঁর সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান ৫ দিনের রিমান্ডে ছিলেন। আজ সোমবার পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। র‌্যাব-১ কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানিয়েছেন, মতিঝিলের ছয়টি ক্লাব থেকে তিনি প্রতি সপ্তাহে ৫০–৬০ লাখ টাকা চাঁদা পেতেন। ক্যাসিনোর পাশাপাশি গুলিস্তানের ছয়টি মার্কেট থেকে তোলা চাঁদার টাকাও তাঁর কাছে আসত। মতিঝিল ও গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ–ছয় লাখ টাকা করে পেতেন তিনি। এসব টাকার হিসাব-নিকাশ রাখতেন আরমান। আরমান সেই টাকার ভাগ বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দিতেন। যাঁদের টাকা দিয়েছেন, তাঁদের সবার নাম র‌্যাবকে বলেছেন সম্রাট। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তদন্তে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা জানান, সম্রাট শারীরিকভাবে অসুস্থ দাবি করায় তাঁকে সাবধানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তিনি ভেঙে পড়েছেন। সম্রাট তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর যাঁরা ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে তাঁকে থাকতে বলেছিলেন, এক পর্যায়ে তাঁদের সবাই নিরাপদে সরে পড়েন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম গতকাল রোববার বলেন, সম্রাট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন এবং অনেকের নামও বলেছেন। এসব তথ্য যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আরমানকে আজ সোমবার আবার রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করা হবে।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো গডফাদার সম্রাট তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মাহানগর দক্ষিণ যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে কয়েকজন সহযোগীকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুরোধে দলে স্থান দিয়েছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুরোধে তার হাত ধরেই যে পাঁচ সহযোগী দলে পদ পেয়েছেন গ্রেফতারের পর এমন পাঁচ সহযোগীর নামও বলেছেন সম্রাট।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুরোধে তাদের দলে অনুপ্রবেশ ঘটাতে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের তিনি ‘ম্যানেজ’ করেছেন। এছাড়া দলে তার চারজন গডফাদার আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তাদের নিয়মিত বড় অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। গডফাদারদের নাম প্রকাশ করে বলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন, শুধু আমাকে কেন?

সম্রাট বলেন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই আমি বেপরোয়া হয়ে উঠেছি। গডফাদার নেতাদের আপনারা জিজ্ঞাসা করে দেখেন, ঢাকায় একটি সমাবেশ করতে কত টাকা লাগে। কে দিয়েছে এই টাকা। আমার কাছ থেকেই সবাই টাকা নিয়েছে।

সম্রাট জানান, সিঙ্গাপুরে হুন্ডি হক নামে পরিচিত এক ব্যক্তির সহায়তায় বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন। তার কাছ থেকে হকের একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর উদ্ধার করা হয়েছে। এটি ধরে হকের সন্ধান চলছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে সম্রাট এবং তার সহযোগী আরমানকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট যে চার গডফাদারের নাম বলেছেন, তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

এর আগে সম্রাট বলেছেন, দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহম্মদ মানিক ও সৈয়দ নাজমুল মাহমুদ মুরাদের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তাদের অনুরোধে সোহরাবকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়। এ দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের আরেক সহযোগী খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকেও সাংগঠনিক সম্পাদক করেন সম্রাট। তাকে যুবলীগে বড় পদ দিতে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানেরও তদবির ছিল। দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি আরমানের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্যা পলাশের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। কাইল্যা পলাশ নিজেই যুবলীগ দক্ষিণের পদপ্রত্যাশী ছিল।

কিন্তু তার পরিবর্তে আরমানকে পদ দেয়া হয়। এছাড়া দুই যুগ্ম সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কী এবং জাহিদ সিদ্দিকী তারেককেও যুবলীগের পদ দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ভূমিকা ছিল।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কমিটি গঠনের কিছুদিন পর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে গুলশানে মিল্কীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন এই খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তারেক র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়।

এই পাঁচজন ছাড়া সন্ত্রাসীদের অনুরোধে তাদের অনেক সহযোগীর যুবলীগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলেও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এ বিষয়ে তারা খোঁজ নিচ্ছেন। এদিকে ক্যাসিনোর বিষয়ে কারা তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছে, এ বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য দিয়েছেন সম্রাট।

এর আগে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি’র) জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।

ক্যাসিনো, অবৈধ মার্কেট, দোকান, ফুটপাত, মাদক ব্যবসার কমিশনসহ বিভিন্ন খাত থেকে তার উপার্জিত টাকা কোথায় রাখা হয়েছে; দল ও দলের বাইরে আড়ালে থেকে এসব অপকর্মে কারা তাকে সহযোগিতা করতেন এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে।

সম্রাট ডিবিকে বলেছেন, ক্যাসিনোর টাকার ভাগ তো অনেকেই পেয়েছেন। শুধু তাকে কেন দায়ী করা হচ্ছে? তাকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে? অন্যদের কেন নয়? এদিকে সম্রাটের মামলা দুটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অস্ত্র ও মাদক আইনের দুই মামলা তদন্ত করছে র‌্যাব। মঙ্গলবার রাতে মামলা দুটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আবদুল বাতেন। পরে বুধবার তাকে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

রিমান্ড মঞ্জুরের পর সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে প্রথমে ডিবি হেফাজতে রাখা রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- ক্যাসিনো বাণিজ্য, অবৈধ মার্কেট, দোকান, ফুটপাত, মাদক ব্যবসার কমিশনসহ বিভিন্ন খাত থেকে উপার্জিত টাকা কোথায় রাখা হয়েছে? উল্টো ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন- শুধু আমি একা কেন? ক্যাসিনোর টাকা তো অনেকেই পেয়েছেন। তারা কেন বহাল তবিয়তে?

প্রসঙ্গত, গত ৬ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তার সহযোগী আরমানকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে তাদের যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে গত ০৭ অক্টোবর সম্রাটের বিরুদ্ধে রমনা মডেল থানায় র‌্যাব-১ এর ডিএডি আব্দুল খালেক বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন।

আলোচিত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ঢাকার জুয়াড়িদের কাছে ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত। জুয়া খেলাই তার পেশা ও নেশা। প্রতি মাসে ঢাকার বাইরেও যেতেন জুয়া খেলতে।

সম্প্রতি রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন সম্রাটের ডান হাত হিসেবে পরিচিত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এর পর ধরা পড়েন রাজধানীর টেন্ডার কিং আরেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীম।

 
Electronic Paper