সেবা কম স্বেচ্ছাচার বেশি
মোবাইল ফোন কোম্পানি
সুলতান মাহমুদ
🕐 ১০:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
দেশের মোবাইল ফোন অপারেটগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি গ্রাহক থাকায় মিলছে না কাক্সিক্ষত সেবা। চটকদার প্যাকেজের নামে প্রতারণা, দুর্বল নেটওয়ার্ক ও কলড্রপ, ভুতুড়ে সেবায় টাকা কেটে নেওয়া, রাত-বিরাতে প্রমোশনাল এসএমএস, ইন্টারনেট সেবায় চরম স্বেচ্ছাচারিতা- এ রকম অভিযোগের পাহাড় গ্রাহকদের। দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৩ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আর সক্রিয় সিমের সংখ্যা সাড়ে ১৫ কোটি।
এ বিপুলসংখ্যক গ্রাহকই মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি। বাজে ও নিম্নমানের সেবা দেবার মাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আবার সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করছে না। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাহলে এসব কোম্পানিগুলো কি তবে আইন-আদালত, নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে।
বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকের অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছে। অধিদফতরে জমা হওয়া অভিযোগের ৬৫ শতাংশের বেশি এ সব কোম্পানির বিরুদ্ধে। প্রতারণা বন্ধে সর্বোচ্চ আদালত থেকে নানা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু কিছুতেই শুধরায়নি তারা।
ফোন কোম্পানিগুলো জনগণকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা দিচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব সরকারি সংস্থা বিটিআরসির। কিন্তু ফোন কোম্পানিগুলোর শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছে না সরকারের এই সংস্থাটি। বর্তমানে দুটি কোম্পানির কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়ে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাচ্ছে সরকারের এই সংস্থাটি। যে কারণে, কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মানুষের হাজারো অভিযোগ থাকলেও এগুলো বলার উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছে না। ফোন কোম্পানিগুলো এদেশে এখন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ে বেশি দাপট দেখাচ্ছে। তারা এতই দাপট দেখাচ্ছে যে, সরকারের পাওনা টাকা দিতে চাচ্ছে না। দেশের ৬টি ফোন কোম্পানির (বেসরকারি গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল ও সিটিসেল এবং আর রাষ্ট্রীয় কোম্পানি টেলিটক) মধ্যে গ্রামীণফোনের কাছে সরকার সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাবে। আর রবির কাছে পাবে সাড়ে ৮শ কোটি টাকার মতো। এই টাকা উঠাতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সব শেষ কোম্পানি দুটিতে প্রশাসক বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি দেশে সরকারের চেয়ে কেউ শক্তিশালী নয়। সেই সরকারকে যদি একটি কোম্পানির কাছ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে এভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হয়, তাহলে জনগণ যদি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত সেবা না পায় তাহলে তারা কি করতে পারেন।
গ্রাহকদের মতামত না নিয়ে কলরেট ও অন্যান্য চার্জ বাড়ানো যাবে না, কলড্রপ হলে ওই কলের টাকা মোবাইল ফোন অপারেটররা কেটে নিতে পারবে না, মোবাইল গ্রাহকদের অনাবশ্যক ক্ষুদে বার্তা পাঠানো যাবে না, বিশেষ বিশেষ স্থান থেকে মোবাইল টাওয়ার সরিয়ে ফেলতে হবে হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা থাকলেও মোবাইল ফোন অপারেটররা তা মানছে না। ফোন কোম্পানিগুলো তরঙ্গের বিপরীতে গ্রাহক সংখ্যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলো চেয়ে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। যে কারণে যেমন বাড়ছে কলড্রপ বাড়ছে। নেটওয়ার্ক কভারেজ বাড়াতে কোম্পানিগুলো যত্রতত্র বিটিএস বসানোয় তেজষ্ক্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
সূত্রে আরও জানা গেছে, বর্তমানে দেশে অপারেটরদের তরঙ্গের পরিমাণ গ্রামীণফোনের ৩৭ মেগাহার্টজ- সেবা দিচ্ছে ৭ কোটি ২৫ লাখ গ্রাহককে। অর্থাৎ প্রায় ২০ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ১ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহৃত হচ্ছে। রবির ৩৬.৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গের বিপরীতে গ্রাহক প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ১৪ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ১ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলালিংকে ৩ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে তরঙ্গ আছে ৩০.৬ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ১ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটকের ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে তরঙ্গ আছে ২৫.২ মেগাহার্টজ। অর্থাৎ প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে ব্যবহৃত হচ্ছে ১ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। অথচ পাশর্^বর্তী দেশসহ কয়েকটি দেশের তরঙ্গ ব্যবহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১ মেগাহার্টজ তরঙ্গের বিপরীতে গ্রাহক শ্রীলঙ্কায় ২ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে ১ লাখ ৪০ হাজার, আফগানিস্তানে ২ লাখ ৯০ হাজার, নেপালে ৫ লাখ ২২ হাজার, মালয়েশিয়ায় ২ লাখ, অস্ট্রেলিয়ায় ১ লাখ ২০ হাজার, জার্মানিতে ৩ লাখ ৯৯ হাজার।
কম পরিমাণ তরঙ্গের বিপরীতে সিম ব্যবহার বেশি হওয়ায় একদিকে যেমন কলড্রপ বাড়ছে অন্যদিকে নেটওয়ার্ক দুর্বল হয় পড়ছে। নেটওয়ার্ক কভারেজ বাড়াতে যত্রতত্র বিটিএস বসানোর চেষ্টা চালায় ফোন কোম্পানিগুলো। কিন্তু বিটিএস থেকে ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়ানোয় হাইকোর্টে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যত্রতত্র বিটিএস বসানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ১১ দফা নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছে- মোবাইল টাওয়ার বাসার ছাদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কারাগার, খেলার মাঠ, জনবসতি এলাকা, হেরিটেজ ও প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাসহ ইত্যাদি স্থানে না বসানো এবং যেগুলো বসানো হয়েছে তা অপসারণ করতে হবে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনার পর অপারেটরগুলো বিটিএস সরিয়েছে নেওয়ার নজির নেই।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ গতকাল খোলা কাগজকে বলেন, ফোন অপারেটরগুলোর কাছে দেশের সাধারণ মানুষ জিম্মি। ফোন অপারেটরগুলো কোনো আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি কিছুই মানছে না। তারা যা খুশি তাই করছে। ফোন অপারেটর কোম্পানির অনিয়ম দেখার যাদের দায়িত্ব তার ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে ফোন কোম্পানির ওপর দীর্ঘ অডিট চালায় বিটিআরসি। এরপর তারা দাবি করে যে, গ্রামীণফোনের কাছে তারা ১২,৫৭৯.৯৫ কোটি টাকা এবং রবির কাছে পাবে ৮৬৭.২৩ কোটি টাকা পাবে। কিন্তু ফোন কোম্পানি দুটি সরকারকে টাকা না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন টালবাহান শুরু করে। এ টাকা আদায়ে ব্যান্ডউইথ সীমিত করা এবং প্যাকেজ ও সরঞ্জামের ছাড়পত্র (এনওসি) দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল বিটিআরসি। তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর দুই অপারেটরকে লাইসেন্স (টু-জি ও থ্রি-জি) বাতিল কেন করা হবে না, তা জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। জবাবের সময় ৩০ দিন। চিঠির পর গ্রামীণফোন বরাবরের মতোই পদক্ষেপটিকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছে। বিটিআরসির চিঠির আগেই নিরীক্ষার বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জেলা দায়রা জজ আদালতে মামলা করেছে গ্রামীণফোন ও রবি। গত ২৫ আগস্ট রবি প্রথমে মামলা করে, পরের দিন মামলা করে গ্রামীণফোন। ২৬ আগস্ট এই চিঠির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থ আদায়ের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে গ্রামীণফোন নিম্ন আদালতে একটি মামলা করেন। এরপর ২৮ আগস্ট নিম্ন আদালত গ্রামীনফোনে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। পরে ওই না মঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে গ্রামীণফোন হাইকোর্টে আপিল করে। ওই আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে দুই মাসের জন্য গ্রামীনফোনের কাছ থেকে টাকা আদায়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় হাইকোর্ট।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক বলেছেন, সরকারি টাকা আদায়ে কোম্পানি দুটিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রশাসক নিয়োগে সরকারের অনুমতি পাওয়া গেছে। প্রতিটি কোম্পানিতে যে চারজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। তার মধ্যে একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। বাকি তিনজন দেখবেন আইনগত বিষয়, প্রকৌশল এবং আর্থিক ও মার্কেটিং বিষয়।