অস্থিরতা বাড়ছে শিক্ষাঙ্গনে
সুলতান মাহমুদ
🕐 ১০:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০১৯
দেশের শিক্ষা খাতকে সুসংহত এবং মজবুত করতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও চলতি বছরের শুরু থেকে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা লক্ষ করা গেছে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার কারণ আলাদা হলেও অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অস্থিরতা বিরাজমান, মাঝেমধ্যে তা বাড়ছে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষাকার্যক্রম, আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজট বাড়ার।
এমন পরিস্থিতির কারণ এবং সমাধানের উপায় এখনই ভেবে দেখা দরকার বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। বুয়েটে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে এক ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবি ও ফলশ্রুতিতে ভিসির পদত্যাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা থেকে ভিসি কোটি টাকা ছাত্রলীগ নেতাদের ঈদ বোনাস হিসেবে দিয়ে দেওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিরকুটে ভর্তি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি না থাকায় ভর্তি কার্যক্রমে স্থবির হয়ে পড়ায় ভিসি নিয়োগ দাবিসহ বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। এছাড়াও চলতি বছরের শুরু থেকে থেমে থেমে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কারণে অস্থির হয়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
কেন শিক্ষাঙ্গনগুলোয় এই অস্থিরতা, পেছন থেকে কোনো শক্তি কলকাঠি নাড়ছে কিনা তা ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিষয়গুলো সরকারকে গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা আরও বলছেন, শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের অভাব, প্রশাসনের দুর্বলতা, বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট, নৈতিক মূলবোধের অভাব প্রভৃতি কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। এতে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লেখাপড়া। কমছে শিক্ষার মান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ আবুল কাশেম ফজলুল হক খোলা কাগজকে বলেন, আমি তো শিক্ষাঙ্গনে কোনো অস্থিরতা দেখছি না। একটি দলের ছাত্র সংগঠন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। কেউ বিরোধিতা করলে তার ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, হত্যাও করা হচ্ছে। বুয়েট ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যা তার বড় উদাহরণ। এটা অনেক বড় ঘটনা। কিন্তু সরকার তো সব কিছু ঠিকঠাক মতো সামাল দিয়েছে। দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষা নেই, ছাত্রদের মধ্যে কোনো নীতি বা আদর্শ নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেহেতু শিক্ষা নেই, মূল্যবোধও নেই। এখন টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি এসব করছে ছাত্ররা। আর শিক্ষকরা পেছন থেকে তা সাপোর্ট করে যাচ্ছে, সুবিধা ভোগ করছে। দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসন সর্বত্র এক ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক খোলা কাগজকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে সামগ্রিকভাবে তার মূল কারণ আস্থার সংকট, বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। এই অবিশ্বাসের কারণ কোথাও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ, কোথাও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ, কোথাও আবার স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি। তিনি বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় অভিযোগগুলো তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) দায়িত্ব নিতে হবে মনে করেন ড. আরেফিন সিদ্দিক।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কয়েক চুক্তির সমালোচনা করে গত ৫ অক্টোবর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। এর জের ধরে বুয়েটের কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গত ৬ অক্টোবর গভীর রাতে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর থেকেই বুয়েট ক্যাম্পাসে অস্থিরতা শুরু হয়। বুয়েট ক্যাম্পাস বর্তমানে কিছুটা শান্ত থাকলেও গত ৭ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল খুবই উত্তল। এদিকে ফেসবুক স্ট্যাটাসের জেরে গত ১১ সেপ্টেম্বর এক ছাত্রীকে বহিষ্কারের কারণে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) উত্তাল হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপাচার্যের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠলে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেন উপাচার্য। তবে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি থেকে সরে আসেনি শিক্ষার্থীরা। পরে উপাচার্যে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও এখনো অস্থিরতা পুরোপুরি কমেনি। ক্যাম্পাসে সাবেক ভিসিপন্থীরা বর্তমানে বেশ কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে এখনো সেখানে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়নি। এদিকে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে সরকার সমর্থক এই ছাত্রসংগঠনের একাংশ। ৪০ লাখ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদকের পদ নেওয়ার বিষয়ে অডিও ফাঁস হলে তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এরপর তাকে কয়েক দফা ক্যাম্পাস থেকে ধাওয়া দিয়ে বের করা হয়। এই ইস্যুতে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের একাংশের আন্দোলনের মুখে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রক্টর মাহবুবর রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন প্রক্টর নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের ঈদ বোনাস হিসেবে উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম কোটি টাকা দিয়ে দেওয়ার পর থেকে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একাংশ। ভিসি টাকা দেওয়া কথা অস্বীকার করলেও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা স্বীকার করেছেন যে, ভিসি তাদের টাকা দিয়েছেন। বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এখনো ভিসি পদত্যাগ দাবিতে অনড় রয়েছেন। তবে ভিসি বলেছেন মিথ্যা অপবাদ নিয়ে তিনি পদত্যাগ করবে না।
এদিকে সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই চিরকুটের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছাত্রলীগের ৩৪ নেতাকে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই চিরকুটের মাধ্যমে ভিসি তাদের ভর্তির নির্দেশ দেন। এ জন্য শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। তাদের দাবি উপাচার্য হয়ে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এ ধরনের অন্যায় করে পার পেতে পারেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান অবশ্য বলেছেন, এই ৩৪ শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি তদন্ত করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।